Published on – Sunday, November 23, 2025
হ য ব র ল
মৃত্যুঞ্জয় দেবনাথ
আসুন, পরিচয় করিয়ে দিই। ইনি সৌম্যজিৎ, অর্থাৎ মিস্টার পাপান।
আমার শ্রীমান। লেজুড়বিহীন আস্ত হনুমান একটি। মুখে ‘উফ্-উফ্’ শব্দটিই ছাড়েন না কেবল, বাকি সব সিমটমই ওই উৎকট প্রাণীটির মতন। যেমন, জীবনে হাঁটতে শেখেননি ইনি। ছোটেন। এবং তিরবেগে। কালেভদ্রে স্থির হয়ে বসেন। দিন-রাতের অধিকাংশ সময়ই সারা সিঁড়ি-বারান্দা আর ঘরজুড়ে লাফান, ঝাঁপান। নৃত্য করেন। কখনো দক্ষিণী স্টার প্রভু দেবা, কখনো জিৎ, বা দেব-রূপে। অত্যাশ্চর্য এই, সকলের মুখে তবুও ‘ভালোছেলে’ বলেই পরিচিত এই পাপানচন্দ্র। উদাহরণ, রাত্রি-দিন চব্বিশঘন্টা লায় দিয়ে মাথায় তোলা ঠাকুমার কাছে সোনারচাঁদ। প্রানবল্লভ। ঠাকদার নয়নের মণি।
আর ওই যে, বেলা ন’টা তিরিশেও খাটে শায়িত, ইনিই আমার সহধর্মিনী। আলপনাদেবী।
আলস্যের বটবৃক্ষ একখানি। তেমনি সৌখিন, মোমের পুতুল। ফুলের ঘায়ে মূর্ছা যান। কিন্তু ঠোঁট উল্টে বলতে যাবেন কিছু এইসব অভিযোগ জানিয়ে-টানিয়ে, তবেই হয়েছে, বাক্যবাণে ভূপতিত হবেন তক্ষুনি। অর্থাৎ এমনই বিষমিশ্রিত সে বাক্যবাণ। এমনই দাহসৃষ্টিকারী, জ্বালাময়ী। একবার সম্মুখ সমরে পড়েছেন তো সহজেই অনুমান করতে পারবেন, এর চাইতে জ্বলন্তঅগ্নিকুণ্ড কত শীতল।
আমার গল্পের প্রধান চরিত্র এ-দুটিই।
কেন এ-দুটি?
এমন প্রশ্নও করতে পারেন নিশ্চয়ই কেউ-কেউ। উত্তরে বলে রাখি, এমন অলস এবং হযবরল প্রাণী ভূভারতে আর দুটি আছে বলে আমার ধারণা নেই। যদি থাকে, সত্ত্বর যোগাযোগ করুন আমার ঠিকানায়। গল্পের প্রধান চরিত্রের নামগুলির বদল ঘটিয়ে নতুন নাম লিপিবদ্ধ করব।…
পাপানের বয়স এই তেরো।
ক্লাস এইট। স্কুল শ্রীভবন উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়। ইংলিশ মিডিয়াম। ভালো স্কুল, ডিসিপ্লিন্ড। তেমনি মারকুটে, কড়া প্রিন্সিপাল। পান থেকে চুন খসলেই কেলো। হয় পিটিয়ে তুলো-তুলো করে ছাড়বেন, নয় তিনঘন্টা নীলডাউন। আরো একটু বেশি হলে গার্জেন কল; অথবা টি.সি.। অর্থাৎ তোমার মতন সুপুত্তুরের দরকার নেই আর আমাদের স্কুলের। অন্যত্র পথ দেখো। টা-টা!
স্কুলটাতে ভর্তি করাতে পেরে মনে-মনে বেশ তৃপ্ত আমি।
ভাবলাম, যাক, এবে যদি একটু লম্ফঝম্প কমে হনুমানটার। এইবার যদি লেজখানি খসে। কড়ার-কড়া সব স্যার-আন্টিদের খপ্পরে পড়ে একটু শান্ত-শিষ্ট, ভদ্র হয় যদি।
সেদিন ঘুম থেকে ডেকে তুলে মা-ব্যাটা দু’জনকেই কড়কে দিলাম খুব।
দ্যাখো, এ-বাড়ি আমার। আমার নিজের হাতে গড়া। যত্ন-আত্তি করতে না-পারো কেটে পড়ো। বসে-বসে অনাচার করতে দেব না এখানে কাউকে। এই বলে রাখলাম।
শুনে কিছুক্ষণ চুপ থাকল দু’জনে। খানিক হাবার মতোই। আসলে কথা খুঁজে পাচ্ছিল না কিছু আচমকা। সবে ঘুম থেকে উঠল কিনা। কিঞ্চিৎ সময় নিয়ে ছক-টক কষে মুখ খুললেন আমার সহধর্মিনী। কটাস-কটাস করে আমায় ঘাড় মটকানোর সুরে বলে উঠলেন, দ্যাখো, তোমার এমন হুংকার এই নিয়ে সহস্র-লক্ষ দিন শুনলাম। আর শুনব না, এও বলে রাখলাম। আরো শুনে রাখো, বাড়িটা তোমার একার নয়। সমান অংশীদার আমরা দু’জনেও। ওইসব অলুক্ষুনে কথা বলে আর একদিন খোঁটা দিতে শুনেছি তো-
তো? কী করবে শুনি? পটাং করে উত্তর করলাম আমি।
বাড়িটাকে উল্টে ফেলে, তোমার ঘাড় মটকে, তবে বিদেয় হব।
শুনে আঁতকে উঠলাম আমি। কথাও হারিয়ে ফেললাম সাময়িক। বলে কী এ? কথার বহর দেখে চক্ষুস্থির আমার। বালিশ থেকে মাথা তুলেই এমন অলুক্ষুনে কথা! বেটির সাহস কম নয়!
আমি চোখ ছানাবড়া করে, হাঁ-হয়ে তাকিয়ে তখনো।
সেদিকে তাকিয়ে খটখটিয়ে হেসে উঠল আমার হনুমানছানাটি অমনি। আশ্চর্য! লজ্জা-ভয় নেই একটু! মায়ের কথায় তাল দিয়ে দাঁত নিটকোচ্ছে সমানে? বাপটার জন্যে একরত্তি মায়া-দয়া বলতেও নেই! কুলাঙ্গার! বেয়াদব, অসভ্য একটি! ইচ্ছে হচ্ছিল হাতে ধরা হাতুড়িটাই ছুঁড়ে মারি ওটির মুখে। অথবা তুলে আছাড় মারি একটি। কটাস্-কটাস্ করে মেরুদণ্ড ভাঙি ওর।
রাগ সংবরণ করলাম পরক্ষণে।
মনে ভাবলাম, ওরই বা দোষ কী। ওই এক ডাইনিবুড়ির পাল্লায় পড়েই তো গোল্লায় গেল অপগণ্ডটা।
নাঃ, মন-মেজাজ ভালো নেই ইদানীং।
রাদ্দিন এই খিচির-মিচির, যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলা আর কাঁহাতক সহ্য হয়। অফিসে গিয়েও শান্তি নেই একদণ্ড। দুনিয়াটা শয়তান-সুবিধাবাদীতে ভরে গেছে সব। সৎ বলতে নেই কেউ। নিজের স্বার্থটি চরিতার্থ করতে গিয়ে কে-কখন কার পেছনে লাগবে, তাই নিয়ে ব্যতিব্যস্ত সকলে। তো, একা যুধিষ্ঠির সেজে বসে থেকে আমি-বা কী করবো? তাই সেখানেও জুটছে কপালদোষে লাথি-ঝাঁটা। দশচক্রে ভগবান ভূত হয়ে চলি নিত্যদিন-ই।
ভাবছি, এবারে আর রেগে কাঁই হব না। যা বলার ধীরে-সুস্থেই বলব। বুঝিয়ে-সুজিয়ে। প্রদীপদাও বলছিলেন এমনটাই। অমন নরম-সরম কথাতেই নাকি কাজ বেশি হয়। যেমন হোমিওপ্যাথ। গমন ধীরে-ধীরে। অথচ রোগের গভীরে প্রবেশ; এবং মূলোৎপাটন।
রাতে ঘুমোতে গিয়ে আসল কথাটা পাড়লাম তাই, বেশ মিহি সুরেই।
মা-ব্যাটার যৌথ উদ্যোগে চলতে থাকা দিবারাত্র ঘরময় হযবরল উৎসবের বিষয়ে। বললাম, আরো একটু গোছগাছ করে চললে হয় না? ঘরটা আর জঞ্জালে পরিণত হয় না তবে রোজ-রোজ এমন। দেখতেও সুন্দর লাগে। তাছাড়া, নিয়ম-শৃঙ্খলারও তো দরকার জীবনে। নয় কী বলো ?
খানিক আকাশ থেকেই পড়লেন উনি।
অর্থাৎ আমার অর্ধাঙ্গিনী, আলপনা। চোখ পিটপিট করে বলল, মানে? কী বলছ, বুঝছি না তো কিছু। আরেকবার বলো।
আমি আর একবার আমতা-আমতা করি।
বলছিলাম, তোমরা মা-ব্যাটা দু’জনে আরো একটু শৃঙ্খলাপরায়ণ হয়ে উঠলে হয় না? আরো একটু সৌন্দর্যসচেতন? দায়িত্বসচেতন? এভাবে ছেলেটিরও যে সর্বনাশ ডেকে আনছো। ও যে ছোটো এখনো। এই বয়স থেকেই একটু নিয়ম-শৃঙ্খলা, দায়িত্ববোধ- এ-সবের পাঠ নেওয়া প্রয়োজন নয় কী? তা নইলে কবে আর শিখবে বলো? এভাবে ও কখনো একজন আত্মনির্ভরশীল-সাহসী-চরিত্রবান মানুষ হয়ে উঠতে পারবে ভেবেছো? কোনোদিনও না। দায়িত্বজ্ঞানহীন, উশৃঙ্খল, অপগণ্ডই তৈরি হবে একটি।
বেশ তো, তা বুঝিয়ে-সুজিয়ে বললেই হয়। হল্লা করো কেন এমন রোজ-রোজ? দিনরাত তো ছেলেটাকে এই মারছ, এই ধরছ অবস্থা। পারলে গিলেই খাও যেন সরবত করে ওটিকে। ছেলের সঙ্গে কেউ এমন ব্যবহারও করে বুঝি? আমার সঙ্গেও তাই করে চলেছো দিবারাত্র। অথচ ভালো মুখে বললে কী না হয়। কথা বলতে গিয়ে এমন লাফাও-ঝাঁপাও যে, তাই দেখে আমারও রাগ মাথায় চড়ে। তারপর উল্টোসিধে বলি। চোখ লাল করি।
ভারী লজ্জা পাচ্ছিলাম শুনে। অবাকও হচ্ছিলাম।
মনে-মনে বলি, আশ্চর্য! কী বলতে চাইছে আলপনা। আমিও তবে আমার শ্রীমানটির মতনই লম্ফঝম্প মারি! ছিঃ-ছিঃ! তা যে ভারী অন্যায়। শৃঙ্খলার পাঠটা যে তবে আমাকেও নিতে হয় এবারে ওদের সঙ্গে-সঙ্গেই।
পরদিন অফিস থেকে ফিরে তাজ্জব!
আশ্চর্য! নরম কথার ওষুধে কাজ হয়েছে বুঝি। যাকে বলে, প্রম্পট অ্যাকশন। এদ্দিনকার এলামেলো-আবর্জনাময় ঘরদোর, আজ একেবারে অচেনা। আদ্যোপান্ত ঝকঝকে, পরিপাট! কোথাও এলোমেলো বা হযবরল শব্দের নামগন্ধ নেই। চতুর্দিক পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। সুসজ্জিত, সুন্দর। ঘরে ঢুকেই কেমন একটা সুগন্ধ-সুগন্ধও নাকে ভেসে আসছিল। খাঁটি রজনীগন্ধার। ঘরে পা-রাখতে চোখে পড়ল ফুলদানিটাও। এতদিন শূন্য হয়ে শুকনো সিলিঙের দিকে হাঁ-করে ছিল। বহুদিন বাদে আবারো ফুল ফুটল ওটিতে!
বড়ো তৃপ্তির শ্বাস টেনে বললাম, আহা, ভারী সুগন্ধ তো! কোথা থেকে আনলে?
একগাল হাসল আলপনা।
তুমি অফিসে চলে যেতে বাজারে গিয়েছিলাম। টুকিটাকি বাজার করে আনলাম। সঙ্গে ওইটি। ক’গোছা রজনীগন্ধা। ভালো হয়নি?
দারুণ! দারুণ! একগাল হেসে বাহবা জানিয়ে বললাম। সত্যিই, এইটিই যে চেয়েছি এদ্দিন। বাড়িটা বেশ ছবির মতো লাগছে আজ। ভেরি নাইস। জাস্ট লাইক আ প্যালেস।
থ্যাঙ্ক ইউ, স্যার। অনেক দিন বাদে আপনার প্রশংসা পাওয়ার সৌভাগ্য হল।
আলপনার ঠোঁট টিপে টিপ্পুনিকাটা হাসির দিকে তাকিয়ে থমকে দাঁড়ালাম। কেন? প্রশংসা করি না আমি? ভালো কাজের নিশ্চয়ই করি!
কক্ষনো না।
আমি চুপ। একটু পরে বলি, তুমিও তাই। আমায় কেবল রাগতেই দেখো। আর কিছু না।
সে যাক গে। সত্যিই সুন্দর লাগছে কিনা আজ বাড়িটা, তাই বলো?
আমি আলপনার দিকে হেসে তাকাই। বললামই তো। দারুণ লাগছে! এক্কেবারে ঝকঝকে, তকতকে! যাকে বলে, দৃষ্টিনন্দন!
কিন্তু এত্ত সাজিয়ে-গুছিয়ে প্যালেস বানানোর কারণও আছে একটি! ভেবে বলো দেখি? বলে ট্যারা চোখে তাকাল আলপনা।
আমি আকাশ থেকে পড়লাম। কী কারণ?
তুমিই বলো?
আমি মনে-মনে ভাবি, তবে বিবাহ বার্ষিকীই হবে বোধ করি আজ আমাদের। ছাতার মাথা তারিখটিও যে ভুলে বসে আছি দিনরাত্তির লেগে থাকা খিচির-মিচিরের জন্য। নাকি তিনজনার কারোর জনমদিন-টিন? হে ভগবান! তবে এ শৃঙ্খলাপরায়ণ হয়ে ওঠার প্রথম পাঠ-টাঠ কিছু নয়?
ততক্ষণে সহাস্য বদনে মুখ খুলল আলপনা।
বলল, জানো তো, রন্তু আসছে আজ। সঙ্গে তাপসও। বিকেলেই রওনা দিয়েছে ওরা। তাইতো বাজার করে আনলাম একটু। রাতে চিলি-চিকেন, মোগলাই পরোটা হবে। তাপস খেতে ভালোবাসে খুব। আর সঙ্গে নিয়ে এলাম কয়েক ওইসব।
শুনে মনমরা হয়ে তাকালাম।
পরে কৃত্রিম হেসে মনে-মনে বলি, তবু ভালো। হে আমার আলসেরানি, অনেকদিন বাদে ঘরটাকে গোছগাছ করে সুন্দর করে তুলেছো অন্তত। হাত আসুক। কোনো অছিলায় গোছগাছ তো হল তবু। এও বা কম কী? চেয়ে-চেয়ে যে এইটুকুনও পাইনা কোনেদিন!
