Published on – Sunday, November 23, 2025
রায় পরিবার ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
সনৎ ব্যানার্জ্জী
জোড়াঁসাকোর ঠাকুর পরিবার এবং মসুয়ার রায় পরিবার ,দুটি পরিবারই ভগবানের আশীর্বাদ ধন্য বাংলার সংস্কৃতি চর্চার প্রধান কেন্দ্র। ঠাকুর পরিবার সম্বন্ধে আমরা সকলেই অল্প বিস্তর জানি, কিভাবে যশোর খুলনা থেকে কলকাতায় এসে ধনে-মানে- যশে বিখ্যাত হয়েছে।এমনকি রবীন্দ্রনাথের আলোয় আলোকিত হয়েছে। অপরদিকে রায় পরিবার সম্বন্ধে আমরা খুবই অলপ জানি ,অনেকে আবার জানেই না।
মসুয়া ময়মনসিংহের একটি গ্রাম। আজ থেকে ৪০০ বৎসর আগে নদীয়া জেলার চাকদহ থেকে রামসুন্দর দেও নামে এক যুবক ময়মনসিংহের শেরপুর যান। শেরপুর সংলগ্ন যশোরের রাজা তাকে দেখে মুগ্ধ হয়ে তার মেয়ের সাথে ওই যুবকের বিবাহ দেন,সাথে জমিদারি ও ঘরবাড়ি। এরপর থেকে তাদের পদবী হয়ে ওঠে ‘রায়’ এবং বেশ কিছুদিন যশোরে কাটিয়ে মসুয়া গ্রামে চলে আসেন। এই জমিদার বাড়ীর ছেলে কালীনাথ রায়। কালীনাথ রায়ের পাঁচ ছেলে দুই মেয়ে।সারদারঞ্জন,কামদারঞ্জন,মুক্তিদারঞ্জন,কুলদারঞ্জন ও প্রসাদরঞ্জন।সকলেই বিদ্যাবুদ্ধিতে খেলাধুলায় ছিলেন অগ্রনী।পরবর্তীকালে কামদারঞ্জনকে তার এক জ্ঞাতি হরিকিশোর রায়চৌধুরি দত্তক নেন,তখন তার নাম হয় উপেন্দ্রকিশোর রায়।তবে তার অন্যান্য ভাইয়েরাও বিভিন্নভাবে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। কুলদারঞ্জন ও প্রসাদরঞ্জন শিশুসাহিত্যে খ্যাতি পেয়েছিলেন। সারদারঞ্জন ও মুক্তিদারঞ্জন ছিলেন গনিতের অধ্যাপক ও ক্রিকেট খেলার পথিকৃত। আবার প্রমদারঞ্জনের কন্যা লীলা মজুমদারের নাম আমরা সকলেই শুনেছি শিশুসাহিত্যের জন্য।উপেন্দ্রকিশোর রায় ছিলেন সবচেয়ে খ্যাতিমান।তার পুত্রের নাম সুকুমার রায় এবং পৌত্রের নাম সত্যজিৎ রায়।উপেন্দ্রকিশোর বহু বিষয়ে পারদর্শী ছিলেন। তিনি ছোটোদের জন্য খুব ভাল লিখেছেন,ভাল বাজনা বাজাতে পারতেন(সেতার বেহালা হারমোনিয়াম ও পাখোয়াজ),ছবি আঁকতেন,গান লিখতে ও গাইতে পারতেন এবং ছাপাখানা নিয়ে বিস্তর মাথা খাটিয়েছেন। তার প্রতিষ্ঠিত ইউ,এস, এন্ড সন্স ছিল সেকালের এক নম্বর মুদ্রন প্রতিষ্ঠান।
এতক্ষন রায় পরিবার সম্বন্ধে জানলাম।অপরদিকে ঠাকুর পরিবারও ছিল খুবই বিখ্যাত,একথা আমি আগে বলেছি,প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর –দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।এদের সম্বন্ধে বাংলাসাহিত্যে অনেক চর্চা হয়েছে এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নোবেল প্রাইজ পেয়ে সমগ্র ভারতবর্ষ তথা এশিয়া মহাদেশে আলোড়ন তুলেছিলেন।তিনি আমাদের কাছে কবিগুরু,বিশ্বকবি নামে পরিচিত। উপেন্দ্রকিশোর জন্মগ্রহন করেছিলেন ১৮৬৩ খ্রীঃ । ১৮৮০ খ্রীঃ প্রবেশিকা পাশ করেন। তিনি বিবাহ করেন বিখ্যাত সমাজ সংস্কারক দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের কন্যা বিধুমুখীকে।উপেন্দ্রকিশোরের ছেলেমেয়েরা -সুখলতা রাও, সুকুমার ,পূন্যলতা ও সুবিনয় রায় সকলেই শিশুসাহিত্যে সুপরিচিত।১৮৮৩ খ্রীঃ ছাত্রাবস্থাতেই তার ‘সখা’ নামে প্রথম রচনা প্রকাশিত হয়।উপেন্দ্রকিশোরের সাথে রবীন্দ্রনাথের সম্পর্কের সুত্রপাত উপেন্দ্রকিশোর কে দিয়ে। তিনি ১৮৮৪ সালেে প্রেসিডেন্সী কলেজ থেকে বি,এ পাশ করার পর ব্রাহ্ম ধর্মে দীক্ষিত হন। ফলে তৎকালীন সময়ের বহু বিশিষ্ট মানুষ ব্রাহ্ম পরিবারের কাছে আসেন।একই ভাবে ঠাকুর পরিবারের সাথেও পরিচিত হন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জন্মগ্রহন করেছিলেন ১৮৬১ খ্রীঃ ৮ই মে। অর্থাৎ বয়সের দিক থেকে তারা দুজনাই ছিলেন সমসাময়িক। সেইসূত্রে উপেন্দ্রকিশোর প্রায়ই কলকাতা জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়িতে যাতায়াত করতেন এবং সেখানে তার সাথে রবীন্দ্রনাথের পরিচয় হয়, পরিচয় হয় তার গানের সাথেও। সাহিত্য ও সঙ্গীত বিষয়ক আলোচনাতেও উপেন্দ্রকিশোর যোগ দিতেন।তারই উদ্যোগে যখন ডোয়ার্কিন নামক বাদ্যযন্ত্র কোম্পানী খোলা হয়,তখন তিনিই আগ্রহ সহকারে জ্যোতিরিন্দ্রনাথের স্বরলিপি গীতিমালা ডোয়ার্কিন থেকে ছাপানোর ব্যবস্থা করেন এবং নতুন তৈরী হারমোনিয়াম সম্পর্কে মতামত সংগ্রহ করেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্রনাথের। আবার উপেন্দ্রকিশোরের বিভিন্ন কাজকর্ম সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ খুবই আগ্রহী ছিলেন। তার লেখা বইয়ের একনিষ্ঠ পাঠকও ছিলেন রবীন্দ্রনাথ । রবীন্দ্রনাথ যে নিয়মিত উপেন্দ্রকিশোরের বাড়ী য়েতেন,সে সম্বন্ধে তার কন্যা পূন্যলতা চক্রবর্তী “ছেলেবেলার দিনগুলি’ বইতে সুন্দর ভাবে ব্যক্ত করেছেন।
“কবি রবীন্দ্রনাথের সাথে বাবার বিশেষ সৌহার্দ্য ছিল।বাবার বেহালা বাজনার প্রতি তিনি অনুরাগী ছিলেন।প্রতি বৎসর জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়িতে উৎসবের সময় বাবাকে রবীন্দ্রনাথের নতুন নতুন গানের সাথে বেহালা বাজাতে হত। ছোটদের জন্য বাবা যে বই লিখতেন ,তাতেও রবীন্দ্রনাথের আগ্রহ ছিল। বাবার নতুন বই বেরোলেই আনন্দ প্রকাশ করে আরো লিখবার উৎসাহ দিয়ে তিনি চিঠষি লিখতেন। রামায়ন,মহাভারত প্রভৃতি দেশী গল্প শেষ হলে বিদেশী গল্পের ভাষাতেও হাত দিতে তিনি বাবাকে অনুরোধ করেছিলেন,কতগুলি বিদেশী বইয়ের নামও বলেছিলেন।রবীন্দ্রনাথকে মাঝেমাঝে বাবার কাছে আসতে দেখতাম।এখন তার সাদা চুলদাড়ি ঋষির মত চেহারার ছবিই তোমরা বেশী দেখতে পাও ,তখন আমরা দেখতাম তার কালো কোঁকড়ানো চুল,যোয়ান বয়সের চেহারা,সে চেহারাও বেশ সুন্দর ছিল।একদিন রবীন্দ্রনাথ বাবার সাথে দেখা করে আচার্য্য জগদীশচন্দ্রের বাড়ী যাবার জন্য রওনা হলেন,বাড়ীটা কাছেই ছিল,তাই হেঁটেই যাচ্ছিলেন,একটু পরেই আবার ফিরে এলেন।পথে যেতে যেতে দেখলেন একটা মরা ইঁদুর ফুটপাতে পড়ে আছে,দেখে মনে হয় প্লেগেই মরেছে। পাশেই ছেলেপিলেরা খেলা করছে,কত লোক আসছে যাচ্ছে,ইঁদুর থেকে ছোঁয়াচ লাগতে পারে ,সে খেয়াল কারো নাই।তাড়াতাড়ি তিনি ফিরে এসে বাবাকে বললেন।বাবালোক নিয়ে গিয়ে ইঁদুরটাকে কেরোসিন ঢেলে জ্বালাবার ব্যবাস্থা করলেন,তবে তিনি নিশ্চিন্ত হয়ে যেতে পারলেন। কাকারা খুশি হয়ে বললেন, ‘দেখ কবি শুধু ভাবেই ভুলে থাকেন না,সব দিকেই তার দৃষ্টি আছে।” উপেন্দ্রকিশোরের সাথে রবীন্দ্রনাথের সম্পর্ক যে কত কাছের ছিল এই লেখাতেই বোঝা যায়।
আবার রবীন্দ্রনাথ যেমন অনেক পত্রিকায় লিখেছেন এবং পাশাপাশি অনেক পত্রিকার সম্পাদনা করেছেন।সেই রকম ভাবে উপেন্দ্রকিশোর ১৯১৩ সালে ‘সন্দেশ’ পত্রিকা প্রকাশ করে শিশু মনে এক নতুন জগৎ সৃষ্টি করেছিলেন।এক কথায় তিনি বাংলা শিশু সাহিত্যের পথিকৃৎ বলা যেতে পারে।আগেই লিখেছি তিনি বিভিন্ন বাজনা বাজাতে পারদর্শী ছিলেন। পাশাপাশি ছবি আঁকতেও তার অসাধারন ব্যুৎপত্তি ছিল।তেলরঙ,জলরঙ ব্যবহার ছাড়াও চিত্রাঙ্কনে প্রাশ্চাত্য রীতির অনুসরন করেছিলেন।এছাড়া ছোটোদের জন্য লেখা বইপত্রে উন্নত চিত্র মুদ্রন পদ্ধতি হিসাবে তৎকালে পাশ্চাত্যের হাফটোন পদ্ধতি এদেশে প্রবর্তন করেন।তার লেখা ‘ছোটোদের রামায়ন’, ‘ছোটোদের মহাভারত’,’সেকালের কথা’, ‘টুনটুনির বই’,’গুপী গাইন বাঘা বাইন’,এবং ‘বলরামের দেহত্যাগ’ ও রবীন্দ্রনাথের দীর্ঘ কবিতা ‘নদী’ অবলম্বনে সাতটি ছবি সাহিত্য জগতে চিরস্মরনীয় হয়ে আছে।’হারমোনিয়াম শিক্ষা’ ও ‘বেহালা শিক্ষা’র মতো বইও তিনি লিখেছেন।ফটোগ্রাফির চর্চাতেও তার নৈপুন্য ছিল ।সঙ্গীত জগতেও তার কৃতিত্ব অসাধারন।’সাধনা’ ও ‘প্রবাসী’ পত্রিকায় সঙ্গীত বিষয়ে বহু প্রবন্ধ রচনা করেছেন।অপরদিকে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন উপন্যাস, গল্প,কবিতা, ছড়া, নাটক, প্রবন্ধ এবং অসংখ্য সঙ্গীত রচনা করেছেন। শুধুমাত্র সঙ্গীত রচনাই করেননি ,তাতে সুরও দিয়েছেন।অর্থাৎ স্বরলিপিও তৈরী করেছেন।এক্ষেত্রেও প্রথম স্টাফ নোটেশান হয় রবীন্দ্রসঙ্গীতে উপেন্দ্রকিশোরের হাত ধরে।ইংল্যান্ডের বিখ্যাত সঙ্গীত বিশারদ ফক্স-স্ট্রঙ্গওয়েজ যখন,’দি মিউজিকঅব হিন্দুস্থান’ নামে তার বিখ্যাত বইটি প্রকাশ করেন,তখন সেই বইয়ে উপেন্দ্রকিশোরের স্টাফ নোটেশান করা কয়েকটি রবীন্দ্র সঙ্গীত অন্তর্ভুক্ত করা হয়।অর্থাৎ তাদের পরিবারের মধ্যে সম্পর্ক ছিল খুব নিবিড়।তাদের সম্পর্কের কথা লিখতে গেলে উপেন্দ্রকিশোরের পুত্র সুকুমার রায় চলে আসে।সুকুমার সম্বন্ধে না লিখলে এ লেখা সম্পূর্ণ হবে না।সুকুমার রায়ই রবীন্দ্রনাথের সাথে যোগাযোগ রেখে চলেন তিনি জীবিত থাকতেই।পিতা উপেন্দ্রকিশোর সুত্রে বাল্যকাল থেকেই রবীন্দ্রনাথের সাথে সুকুমারের পরিচয়।সুকুমার জন্মগ্রহন করেছিলেন ১৮৮৭ সালের ৩০শে অক্টোবর।বাড়িতে ব্রাহ্ম বালিকা শিক্ষালয়ে পাঁচ বৎসর বয়সে লেখাপড়া শুরু। নবৎসর বয়সে সিটি কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি হন।১৯০২ সালে এন্ট্রান্স,১৯০৪ সালে এফ,এ,পাস করে প্রেসিডেন্সী কলেজে ভর্তি হন এবং পদার্থবিদ্যা ও রসায়ন বিদ্যায় অনার্স নিয়ে বি,এস,সি পাশ করেন ১৯০৭ সালে।এরই মাঝে মাত্র ৮ বৎসর বয়সে তিনি শিবনাথ শাস্ত্রীর ‘মুকুল’ নামে ছোটো পত্রিকায় ‘নদী’কবিতাটি লেখেন। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনের সাথে সুকুমার রায় নেটিভ সাহেবদের ব্যঙ্গ করে লিখলেন ‘রামধন বধ’ নাটিকা। বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও সামিল হয়েছিলেন। কলেজ ছাড়ার কিছুদিনের মধ্যেই আত্মীয় বন্ধুদের নিয়ে প্রতিষ্ঠা করেছেন,’ননসেন্স ক্লাব’।তারপর মানডে বা মন্ডা ক্লাব।এইসময় তিনি ২টি নাটক লেখেন ‘ঝালাপালা” ও’ লক্ষনের শক্তিশেল’।এরপর পিতার মৃত্যুর পরে ১৯১৫ থেকে ১৯২৩ পর্যন্ত ‘সন্দেশ’ পত্রিকার সম্পাদনা করেন।
১৯১১ সালে তিনি একটি বৃত্তি পেয়ে জাহাজে চেপে বিলাত গেলেন। সেখানে তিনি কাউন্টি কাউন্সিল এর স্কুল অফ ফটোএনগ্রেভিং এ্যন্ড লিথোগ্রাফিতে ভর্ত্তি হন।তার পিতা উপেন্দ্রকিশোর খুব ভাল ছবি আঁকতেন একথা আমি আগেই লিখেছি।সেইকারনে তিনি তার পুত্রকে ফটোগ্রাফিতে ও মুদ্রন শিল্প নিয়ে পড়াশোনা করার জন্য বিলাতে পাঠালেন।বিলাত যাবার আগে শান্তিনিকেতনে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ ও অবনীন্দ্রনাথের সহ অভিনেতা রূপে ‘গোড়ায় গলদ’ নাটকে অভিনয় করেন।রবীন্দ্রনাথও পরের বৎসর বিলাত যান।এ সময়ে রবীন্দ্রনাথ যাতে নোবেল পুরষ্কারের জন্য মনোনীত হতে পারেন সেজন্য সুকুমার রায় লন্ডনের East and west society র ডাকে বিখ্যাত Quest পত্রিকায় ‘The spirit of Rabindra nath”শীর্ষক এক প্রবন্ধ লিখে ইংরেজ জনগনের সাথে পরিচয় ঘটাতে সাহায্য করেছিলেন।সুকুমার রায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পুত্রসম।কিন্তু সুকুমার রায়ের রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রতি প্রগাঢ শ্রদ্ধার পরিচয় পাওয়া যায় ব্রাহ্মসমাজের এক নির্বাচন ঘিরে।যেখানে রবীন্দ্রনাথকে পরাস্ত করার জন্য প্রভাবশালী অনেকেই একযোগে সচেষ্ট হয়েছিলেন।তখন সুকুমার রায় ও প্রশান্ত চন্দ্র মহালনবিশ স্বাক্ষরিত ‘কেন রবীন্দ্রনাথকে চাই’ শীর্ষক ৫২ পৃষ্ঠার ইস্তাহার ব্রাহ্মসমাজের সদস্যদের মধ্যে বিতরিত হয়েছি এবং তার ফলে রবীন্দ্রনাথকে পরাস্ত করার পরিকল্পনা ভেস্তে গিয়েছিল। আবার সুকুমারের আগে বাংলাভাষায় কেউই অবিমিশ্র হাস্যরস সৃষ্টি করেননি। তাই পুত্রসম সুকুমারের প্রভাবে পিতৃতুল্য রবীন্দ্রনাথও দাড়ি ও জোব্বায় আড়াল করে রাখা ঋষিসুলভ গাম্ভীর্য সরিয়ে ‘এত বুড়ো কোনোদিন হবো নাকি আমি” বলে ‘খাপছাড়া’ লিখতে শুরু করেছিলেন।সুকুমার রায়ের লেখায় উদ্ভট জন্তু জানোয়ারের কল্পনা আছে।তাদের উদ্ভট নামকরনও করেছেন।যেমন-হাঁসজারু,বকচ্ছপ শব্দগুলি কিন্তু উদ্ভট নয়,রীতিমত শব্দবিজ্ঞানসম্মত। সুকুমার রায় বিলাতে ফটোগ্রাফি সম্পর্কে উচ্চশিক্ষা নিয়েছিলেন।তিনি বিলেতের Royal Photographic Societyর ফেলো নির্বাচিত হন।সুকুমার চিত্রকলা ও সংগীতের মধ্যে আশ্চর্য মিল খুঁজে পেয়ে বলেছিলেন,ছবি আঁকতে লাগে সাতটা রঙ আর গান গাইতে লাগে সাতটা সুর।”
বিলাত থেকে ফেরার পর ১৯১৩ তে ঢাকার জগচ্চন্দ্র ও সরলা দাশের কন্যা সুপ্রভার সাথে বিবাহ হয়।সেই বিয়েতে উপস্থিত থাকার জন্য উপেন্দ্রকিশোর ও সুকুমার দুজনেই রবীন্দ্রনাথকে বিশেষ অনুরোধ করেন।রবীন্দ্রনাথ চিঠিতে জানান জমিদারীর কাজে ব্যস্ত থাকায় বিবাহ অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে পারবেন না।কিন্তু স্নেহের টানে তিনি সবকাজ ফেলে শেষ মুহুর্তে বিয়ের আসরে এসে উপস্থিত হন।
বিলেতের বুদ্ধিজীবী মহলে রবীন্দ্র সাহিত্যকে পরিচিত করার জন্য সর্বাধিক উৎসাহ ছিল সুকুমার রায়ের ।এ ব্যাপারে সুকুমার রায় তার বোন পূন্যলতাকে চিঠিতে লিখেছেন,পরশু দিন মিঃ পিয়ারসন তার বাড়িতে আমাকে বেঙ্গলী লিটারেচার সম্বন্ধে একটা পেপার পড়বার নেমতন্ন করেছিলেন।সেখানে গিয়ে দেখি মিঃ এ্যান্ড মিসেস আর্নল্ড ,মিঃ আ্যন্ড মিসেস রটেনস্টাইন ,ডঃ পি,সি রায় পরভৃতি অনেকে।শুধু তাইনয় ঘরে ঢুকে দেখি রবিবাবু বসে আছেন।বুঝতেই পারছিস আমার অবস্থা।যাই হোক ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরী থেকে ম্যাটেরিয়াল জোগাড় করতে হয়েছিল।তাছাড়া রবিবাবুর কয়েকটি কবিতা ,পরশপাথর, সন্ধ্যা,কুঁড়ির ভিতর কাদিঁছে গন্ধ ইত্যাদি অনুবাদ করেছিলাম।রবীন্দ্রনাথ পরিচিত হলেন ব্রাস্টার্ড রাসেল,এইচ,জি,ওয়েলস,হ্যান্ডেল লোরেজ,ডিকিসন এন্ডরুজ,স্টপফোর্ড,এজরা পাউন্ড ও স্টার্ম মুরের সাথে।
আবার ব্রিস্টনে রামমোহনের সমাধি মন্দিরে রবীন্দ্রনাথ ও সুকুমার রায় একসাথে গিয়েছিলেন,রবীন্দ্রনাথ সেখানে উপাসনা করেন সাথে গান। ১৯১৩ সালের ১৩ ই সেপ্টেম্বর রবীন্দ্রনাথ দেশে রওনা হন,সিটি অব লাহোর নামক জাহাজে।সেই কুড়ি দিনের দীর্ঘ পথের সাথী ছিলেন সুকুমার রায়।
রবীন্দ্রনাথের প্রতি সুকুমার রায়ের শ্রদ্ধা এবং সুকুমার রায়ের প্রতি রবীন্দ্রনাথের স্নেহ কেমন ছিল তার পরিচয় মেলে দুরারোগ্য কালাজ্বরে আত্রান্ত পুত্রপ্রতিম শিষ্যের অন্তিম শয্যার সময়ে।১৯২৩ সালে সুকুমার রায় শেষ শয্যার সময় ছিলেন মাত্র ছত্রিশ বৎসর বয়স।বাঁচার আশা নেই,শেষ ইচ্ছা প্রকাশ করে বললেন রবীন্দ্রনাথকে দেখতে চাই।রবীন্দ্রনাথ এসেছিলেন ।রবীন্দ্রনাথ উপস্থিত হতেই সুকুমার অনুরোধ করলেন,’আছে দুঃখ আছে মৃত্যু” গানটি গাইতে, রবীন্দ্রনাথ গাইলেন।সুকুমার আবার বললেন,’দুঃখ এ নয় সুখ নয়গো ,গভীর শান্তি এ সে” গানটি গাইতে।রবীন্দ্রনাথ আবারও গাইলেন।সুকুমার রায়ের হৃদয়ও ভরে উঠল।এর কিছুদিন পরেই ১০ই সেপ্টেম্বর ১৯২৩ সালে সুকুমার রায়ের জীবনাবসান হয়।
সুকুমার রায়ের মৃত্যুর পর শোকার্ত রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনের মন্দিরে একটি উপাসনার আয়োজন করেন।আচার্যের ভাষনে তিনি বলেন আমার পরম স্নেহভাজন যুবকবন্ধু সুকুমার রায়ের রোগশয্যায় পাশে যখন এয়ে বসেছি,এই কথাই বারবার মনে হয়েছে জীবলোকের উর্ধে আধ্যাত্মলোক আছে।আমি অনেক মৃত্যু দেখেছি,কিন্তু এই অল্পবয়স্ক যুবকটির মতো অল্পকালের আয়ু নিয়ে মৃত্যুর সামনে দাড়িয়ে এমন নিষ্ঠার সঙ্গে অমৃতময় পুরুষকে অর্ঘ্য দান করতে আর কাউকে দেখিনি ।
আবার বলেছেন,’আমার যুবক বন্ধু সুকুমার রায়ের মৃত্যুসংবাদ পেয়েছি।তাকে আমার আত্মীয়জনের মতো স্নেহ করতুম।তিনি দুই বছরের দীর্ঘকাল কঠিন রোগে শয্যাশায়ী ছিলেন,আমি মাঝে মাঝে তাকে দেখতে যেতুম।” সুকুমার রায় হাসির কবিতা লিখে বিখ্যাত হবেন তা কেউ ভাবতে পারেননি।তিনি ভাল ছবি আঁকতেও পারতেন।আবার সঙ্গীতেও তার পারদর্শীতা ছিল।তবে বিশেষ করে প্যারোডি গানে সুকুমার ছিলেন সিদ্ধহস্ত ,বিশেষ করে রবীন্দ্রনাথের গানের।’আমাদের শান্তিনিকেতন’গানের কথা ও সুরের আদলে লেখেন সানডে ক্লাব বা মন্ডা ক্লাবের জাতীয় সঙ্গীত ।’আমাদের মন্ডা সম্মিলন’,বিশ্ববীনার বরের অনুষ্ঠানে তিনি লেখেন,
বৃষ্টি বেগভরে রাস্তা গেল ডুবিয়া
ছাতা কাঁধে জুতা হাতে নোংরা
খোলা কালো,
হাঁটু জল ঠেলি চলে যেত লোক।
আবার সুকুমারের লেখা গান ব্রাহ্ম বিবাহে গাওয়া হয়।গানদুটি হল ,” প্রেমের মন্দিরে তার আরতি বাজে’ এবং নিশিদিন আনন্দধারা’।গানদুটির সুর হুবহু রবীন্দ্রনাথের ‘ছিল যে গারদের অন্ধকারে’ এবং ‘শ্রাবনের ধারার মত’ থেকে নেওয়া। তাদের দুজনার সম্পর্কের কথা বলতে গেলে এরকম অসংখ্য উদাহরন দেওয়া যায়।
তথ্যঋনঃ—সত্যজিতের পরিবার ও রবীন্দ্রনাথ—অমিতাভ চৌধুরী,নবপত্র প্রকাশন।
দ্বাদশ নবদ্বীপ বইমেলা পত্রিকা–শ্যামল মৈত্র,ননসেন্স ভার্স না সেন্সিবল রাইম।
সকালবেলা পত্রিকা–৩০/১০/১২।
সংসদ বাঙালী চরিতাভিধান।
