Published on – Sunday, November 23, 2025
রবীন্দ্রনাথের মানবতাবাদী দর্শন ও বর্তমান প্রেক্ষিত
ড. গুরুপদ অধিকারী
ভারতীয় উপমহাদেশের উনিশ ও বিশ শতকের অন্যতম মনীষী ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। পারিবারিক ঔপনিষদিক চিন্তাধারার উত্তরাধিকার তাঁর চিত্তকে দিয়েছিল প্রসারতা। উপনিষদের ‘ঈশাবাস্য মিদং সর্ব্বং’ অর্থাৎ জগতের সবকিছুই ঈশ্বর দ্বারা আচ্ছাদিত, এই বাণীই ছিল তাঁর জীবনের মূলমন্ত্র। ইউরোপীয় জ্ঞানভাবনা, রমা রঁল্যা, ম্যাক্সিম গোর্কি, মহাত্মা গান্ধী, আইনস্টাইনের সান্নিধ্য তাঁর চিন্তাধারাকে স্বচ্ছ, পরিশীলিত ও বাস্তবরূপ দান করেছিল। যেকারণে তিনি সেসময়ের অন্যতম শ্রেষ্ঠ চিন্তাশীল মনীষী রূপে স্থান পেয়েছিলেন। আত্মানুসন্ধানই ছিল তাঁর জীবনসাধনার অন্যতম অন্বিষ্ট বিষয়। তাঁর দর্শনের প্রধান বাণীই ছিল জনকল্যাণ বা ‘লোকহিত’ সাধনা। সমসাময়িক আর্থ সামাজিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় পরিমণ্ডল এই প্রসঙ্গে বিবেচ্য। ধনীসমাজ চিরকাল নির্যাতন করেছিল নিম্নবর্গের মানুষদের। শিক্ষার অধিকার ও সুযোগ হারিয়ে এই মানুষেরা সেদিন নিজেদের দাসরূপে ভাবতে শুরু করেছিল। হীনমন্যতা তাদের সংকুচিত করে তুলেছিল। আঘাতে আঘাতে ক্রমশ ক্ষয়িষ্ণু হয়ে পড়েছিল সমাজের নিম্নবর্গের মানুষ। কোনোভাবেই চাবুকের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে এরা গর্জে ওঠেনি, বরং, করজোড়ে ঈশ্বরের কাছে নালিশ জানিয়েছে। মহাজন, পুলিশ, মোক্তার, গুরুঠাকুর সবাই নিজস্ব কায়দায় তাদের অনন্তকাল ধরে শোষণ করেছে। আর, “তাহারা কেবল সেই অদৃষ্টের নামে নালিশ করিতেছে, যাহার নামে সমন-জারি করিবার জো নাই”। একটা আত্মঘাতী মানসিকতা সেদিন আমাদের দেশের ‘শোণপ্রাংশু’ ও ‘দর্ভক’- দের আরও নিচে ঠেলে দিয়েছিল।
গোটা উনিশ শতক জুড়ে শাস্ত্র আর ধর্মচর্চার নামে সমাজের উঁচুমহলে চলেছিল জবরদস্তি আর ক্ষমতাবিস্তারের প্রয়াস। দেশ তখন পরাধীন। শিক্ষায়, সংস্কৃতিতে, ধর্মে, আচারে, বোধে সবদিক থেকে প্রকৃত অর্থেই পরাধীন। দেশের অভ্যন্তরে চলেছিল একটা চরম বিভেদের রাজনীতি। এই বিভেদ ধনী ও নির্ধনের মধ্যে, হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে, ব্রাহ্মণ ও শূদ্রের মধ্যে, পুরুষ ও নারীর মধ্যে, শিক্ষিত ও অশিক্ষিতের মধ্যে। একপক্ষ অন্যপক্ষকে কোনোভাবেই স্বীকার করতে চায়নি। এর ফলে সমাজের ভেতরে ভেতরে তীব্র অসন্তোষ ও নৈরাজ্যের সৃষ্টি হয়েছিল। বিশ্বপথিক রবীন্দ্রনাথ এই পরিস্থিতি সম্পর্কে অত্যন্ত সচেতন ছিলেন। দেশের মধ্যে ব্রাহ্ম- হিন্দুত্বের বিরোধ, বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন একটা অস্থির অবস্থার সৃষ্টি করেছিল। ঠাকুরবাড়ির সন্তান রবীন্দ্রনাথ সেদিন মানুষের মধ্যে দূরত্ব মেনে নিতে পারেননি। সমাজের হিন্দু- মুসলমান, উচ্চ- নীচ, শিক্ষিত ও অশিক্ষিত সমাজের মধ্যে তিনি ঐক্যবিধান করতে চেয়েছিলেন। তখন বিশ শতকের গোড়ার দিক। গঙ্গার ঘাটে সামিল হয়ে রাখিবন্ধনের মন্ত্রে তিনি গেয়েছিলেন-
‘বাংলার প্রাণ, বাঙালীর মন
বাঙালির ঘরে যত ভাইবোন-
এক হউক এক হউক
এক হউক হে ভগবান’।
আসলে তিনি বুঝেছিলেন অপমানিতের সঙ্গে সহবাস করতে করতে আমরা নিজেদের কবর নিজেরাই খুঁড়ে চলেছি। এতে আমাদের অগ্রগতি ব্যাহত হচ্ছে। আমরা ক্রমশ পিছু হটছি। তিনি লিখলেন-
‘যারে তুমি নীচে ফেল সে তোমারে বাঁধিবে যে নীচে।
পশ্চাতে রেখেছো যারে সে তোমারে পশ্চাতে টানিছে’।
তাই সবার আগে মানুষের বাঁচার অধিকারকে স্বীকৃতি দিতে হবে। তাদের ভালোবাসতে হবে। কাছে টানতে হবে। কিন্তু সেদিন উচ্চ- নীচ, হিন্দু- মুসলমানের মধ্যে বিভেদের বাতাবরণ সামাজিক ভারসাম্যকে বিঘ্নিত করেছিল। এর পশ্চাতে তিনি যে কারণ অনুসন্ধান করেছিলেন তা ধরা পড়েছে ‘কালান্তর’ গ্রন্থের ‘হিন্দু মুসলমান’ প্রবন্ধে। সেখানে তিনি স্পষ্ট ভাষায় লিখেছিলেন, “ভারতর্ষের এমনি কপাল যে, এখানে হিন্দু- মুসলমানের মতো দুই জাত একত্র হয়েছে- ধর্মমতে হিন্দুর বাধা প্রবল নয়, আচারে প্রবল; আচারে মুসলমানের বাধা প্রবল নয় ধর্মমতে প্রবল। একপক্ষের যে দিকে দ্বার খোলা, অন্যপক্ষের সেদিকে দ্বার রুদ্ধ”। এই মর্মভেদী আঘাত দেশের মধ্যে পীড়াদায়ক পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছিল। যে কারণে স্বদেশি আন্দোলনে আমাদের ডাকে তারা সাড়া দিয়ে এগিয়ে আসেনি। আসলে আমরা বুঝিনি, ‘আমাদের ডাকের মধ্যে গরজ ছিল কিন্তু সত্য ছিল না’। সত্য যখন মুখ ফিরিয়ে থাকে তখন জাতি, ধর্ম, ভাষার মধ্যে যথার্থ মিলন হওয়া সম্ভব নয়। যে-কারণে দেশের নানা স্থানে বেঁধেছিল সংঘাত। যার অনিবার্য পরিণতি রূপে স্বাধীনতার সমকালে হিন্দুস্থান ও পাকিস্তান পারস্পরিক বিচ্ছিন্ন ও বিপরীত দুই দেশের সৃষ্টি হয়েছিল।
একথা ভুললে চলবে না যে, নানা জাতি, নানা বর্ণ, নানা ভাষার সমণ্বয়ের মধ্যেই ভারতবর্ষের সনাতন ঐতিহ্য বর্তমান। এভাবেই যুগ যুগ ধরে এখানে মিশে গেছে বিভিন্ন ধর্মের, বিভিন্ন ভাষার, বিভিন্ন সংস্কৃতির মানুষ। এর ফলে এদেশে জন্ম হয়েছে এক শাশ্বত শক্তির। তাই ধর্মান্ধতা বা সাম্প্রদায়িকতা কখনোই এদেশে কাম্য নয়। শুধু তাই নয়, ধনী- দরিদ্র বা উচ্চবিত্ত ও নিম্নবিত্তের মধ্যে ভেদাভেদ সমাজের মধ্যে এক নৈরাজ্যের সৃষ্টি করেছিল। এই পরিস্থিতিতে কবিগুরুর বিচিত্র লেখনীতে বারবার সেই সময়ের উত্তাপ ধরা পড়েছিল। ‘গোরা’ উপন্যাস রচনা করতে গিয়ে গোরার মুখ দিয়ে তিনি বলালেন, “আমাকে আজ সেই দেবতার মন্ত্র দিন, যিনি হিন্দু, মুসলমান, খৃস্টান, ব্রাহ্ম সকলেরই- যাঁর মন্দিরের দ্বার কোনো জাতির কাছে, কোনও ব্যক্তির কাছে কোনোদিন অবরুদ্ধ হয় না- যিনি কেবলই হিন্দুর দেবতা নন, যিনি ভারতবর্ষের দেবতা”। (গোরা : অধ্যায় ৭৬)। তিনি নিজে ব্রাহ্মধর্মের মানুষ হলেও কোনও সংকীর্ণ ধর্মবিশ্বাস কোনোদিন তাঁকে আচ্ছন্ন করেনি।
পরাধীন ভারতবর্ষের মানুষ যখন ধর্মে, অর্থে, শিক্ষায় ভেতরে ভেতরে খণ্ড বিচ্ছিন্ন, ঠিক তখন বিশ্বের সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলির মধ্যে পারস্পরিক ক্ষমতাপ্রদর্শনের জন্য শুরু হয়েছিল উদগ্র লড়াই। অধিকারবোধের প্রবল তাগিদে শক্তিধর দেশগুলোর মধ্যে শুরু হয়েছে বিশ্বযুদ্ধ। সবল বা ক্ষমতাশীল শক্তির হাত থেকে স্বাধীনতা বা মুক্তির জন্য ছটফট করেছিল অপেক্ষাকৃত দুর্বল রাষ্ট্রশক্তি। ক্ষমতার নামে চলেছিল অমানবিক পেশিশক্তি প্রদর্শন। মানুষের আদিম শক্তির মর্মঘাতী রূপ দেখে বিস্মিত বোধ করেছিলেন কবি নিজেও। আন্তর্জাতিক হানাহানি ও সন্ত্রাসবাদ তাঁকে শঙ্কিত করেছিল। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন, চারিদিকে পরিব্যাপ্ত নাগিনীদের বিষাক্ত নিঃশ্বাসে ভরে উঠেছে সারা পৃথিবী। উনিশ শতকের শেষভাগ থেকেই বিশ্বের সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলির উত্থান ও ক্ষমতার লোভ তিনি দেখেছিলেন কখনো ব্যুয়র যুদ্ধে, কখনো রুশ- জাপান যুদ্ধে আবার কখনো বা বিশ্ব মহাযুদ্ধে। সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলির প্রবল হুহুঙ্কারে আতঙ্কিত হয়ে উঠেছিল সাধারণ মানুষ। তিরিশের দশকে জাপানের মতো একটা ক্ষুদ্র দেশের চিনের মতো এক বৃহত্তর শক্তিকে আক্রমণ তিনি মোটেও মেনে নিতে পারেননি। এই যুদ্ধ নিয়ে জাপানি কবি নোগুচির সঙ্গে তাঁর পত্রযুদ্ধ চলেছিল। এশিয়া, ইউরোপ, আফ্রিকা প্রভৃতি সর্বত্রই ফ্যাসিবাদী শক্তিগুলির তখন ভয়ঙ্কর উত্থান ঘটছিল। ১৯৩৫ সালে ইতালি যখন আফ্রিকার সুপ্রাচীন দেশ ইথিওপিয়াকে আক্রমণ করে তখন শুধু প্রতিবাদ বা বিবৃতি দিয়েই রবীন্দ্রনাথ ক্ষান্ত হননি, ভেতরে ভেতরে উপলব্ধি করেছিলেন তীব্র মর্মযন্ত্রণা। ‘আফ্রিকা’ কবিতায় লিখলেন,
সভ্যতার বর্বর লোভ
নগ্ন করল আপন নির্লজ্জ অমানুষতা।
তোমার ভাষাহীন ক্রন্দনে
বাষ্পাকুল অরণ্যপথে
পঙ্কিল হলো ধূলি
তোমার রক্তে অশ্রুতে মিশে”।
বিশ শতকের তিনের দশকে স্পেনের গৃহযুদ্ধের সময় জেনারেল ফ্রাংকো ১৯৩৬ সালে যখন স্পেনের গণতন্ত্র ধ্বংস করে তখন ‘সেঁজুতি’ কাব্যের ‘চলতি ছবি’ কবিতায় তার প্রতিফলন ধরা পড়েছিল। প্রায় একই সময়ে রাশিয়ান সাম্রাজ্যবাদকেও তিনি সমর্থন করতে পারেননি। ১৯৩৯ সালে রাশিয়া ফিনল্যাণ্ড আক্রমণ করলে ‘সানাই’ কাব্যের ‘অপঘাত’ কবিতায় তার ছবি ধরা পড়ে। তিনি লিখলেন,
টেলিগ্রাম এল সেই ক্ষণে
ফিনল্যাণ্ড চূর্ণ হল
সোভিয়েত বোমার বর্ষণে।
ভেতরের দ্বন্দ্ব, অস্বস্তি আর কষ্টের বহিঃপ্রকাশ ঘটে কবি অমিয় চক্রবর্তীর সঙ্গে পত্রবিনিময়ে। মনুষ্যত্ব বা মানবিক স্বাধীনতা যেখানেই
খর্ব হয়েছে সেখানেই কবি একটা জ্বালা অনুভব করেছেন। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন সমস্ত পৃথিবী হিংসায় উন্মত্ত, পৃথিবী জুড়ে
সভ্যতার চরম সংকট। এত যন্ত্রণা থাকা সত্ত্বেও জীবনের শেষদিন পর্যন্ত তিনি মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারাননি, তিনি উপলব্ধি
করেছিলেন মানুষের মুক্তি ঘটবেই। তাই “সভ্যতার সংকট” প্রবন্ধে লিখলেন, “পরিত্রাণকর্তার জন্মদিন আসছে আমাদের এই দারিদ্র্যলাঞ্ছিত কুটিরের মধ্যে ; … মানুষের চরম আশ্বাসের কথা মানুষকে এসে শোনাবে এই পূর্বদিগন্ত থেকেই”। সভ্যতাভিমানের পরিকীর্ণ ভগ্নস্তুপের মাঝে দাঁড়িয়ে তাঁর অনুভূতি, “মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ, সে বিশ্বাস শেষ পর্যন্ত রক্ষা করব”।
এভাবেই বিপন্ন মানবাত্মার মুক্তিদূত হয়ে উঠেছেন রবীন্দ্রনাথ। তাঁর ভাবনা, চিন্তা বা দর্শনে খণ্ড মানুষ মিশে গেছে বিশ্ব মানবের সঙ্গে। এই বিশ্বমৈত্রী বা বিশ্বমানবতাবোধ তাঁর সমস্ত জীবন ও সাধনার মূলমন্ত্র হয়ে উঠেছে। গানেই সেকথা ধরা পড়েছে, ‘বিশ্বসাথে যোগে যেথায় বিহারো,/ সেইখানে যোগ তোমার সাথে আমারও’। নিজের খণ্ড আমিকে যেমন পূর্ণ আমির মধ্যে দেখেছিলেন তেমনি দেশজ মানুষ, বিপন্ন সর্বহারা মানুষ তাঁর ভাবনায় অখণ্ড বিশ্ব মানবাত্মার সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। এই ভাবনার ওপর ভিত্তি করেই বিগত একশো বছর আগে নির্মিত হয় বিশ্বভারতী। যার মূলমন্ত্রই হলো, ‘যত্র বিশ্বং ভবত্যেকনীড়ম্’। চিরন্তন বিশ্বশান্তি ও মৈত্রী প্রতিষ্ঠা করাই ছিল বিশ্বভারতীর মুলসুর। ‘নৈবেদ্য’, ‘খেয়া’ ‘গীতাঞ্জলি’ পর্বের কবিতায়, ‘ধর্ম’ প্রবন্ধে, ‘শান্তিনিকেতন’ প্রবন্ধাবলীতে এই অনুভূতি যেমন ধরা পড়েছিল, তেমনি জীবনের পরিণত পর্বে রচিত ‘মানুষের ধর্ম’ প্রবন্ধ গ্রন্থে তাঁর এই উপলব্ধি স্পষ্টভাবে ফুটে উঠল। তিনি দেখেছেন, বিভিন্ন গোষ্ঠী ও উপগোষ্ঠীতে বিভক্ত ধর্ম ও সম্প্রদায়ের পারস্পরিক প্রতিকূল ভাবনার জেরে ঈশ্বর নিয়ে গজিয়ে ওঠে প্রতিদ্বন্দ্বী মনোভাব। ধর্ম নিয়ে তৈরি হয় রেষারেষি। যার অন্তিম ও ভয়াবহ রূপ নরঘাতী হানাহানি। এই ধর্ম তাঁর কাম্য নয়। ‘পরিশেষ’ কাব্যগ্রন্থের ‘ধর্মমোহ’ কবিতায় তিনি তাই লিখলেন,
“যে পূজার বেদি রক্তে গিয়েছে ভেসে
ভাঙো ভাঙো, আজি ভাঙো তারে নিঃশেষে—
ধর্মকারার প্রাচীরে বজ্র হানো,
এ অভাগা দেশে জ্ঞানের আলোক আনো”।
সমস্ত সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে তিনি তাই নররূপী নারায়ণ বা মানুষের ঈশ্বরকে প্রত্যক্ষ করেছেন, একমাত্র তিনিই এই মানবের মুক্তিদাতা। ‘যেথায় থাকে সবার অধম দীনের হতে দীন সেইখানে যে চরণ তোমার রাজে’। এভাবেই অসীম অনন্ত পরিব্যাপ্ত ঈশ্বরকে কবি সাধারণ মাটির বন্ধনে টেনে এনেছেন। নাটকে তাদের ‘দাদাঠাকুর’ রূপে মানুষের মধ্যে মিশিয়ে দিয়েছেন। তাঁর গল্পে গানে, তাঁর প্রসারিত সুরে, উদার ছন্দে পরমানন্দে ধরা পড়েছে সীমা ও অসীম মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। নিজের মধ্যে তিনি সেই সত্যকে উপলব্ধি করেছেন,
“সীমার মাঝে অসীম তুমি বাজাও আপন সুর।
আমার মধ্যে তোমার প্রকাশ তাই এত মধুর”।।
এই ঈশ্বর কোনও প্রচলিত ঈশ্বর নন, ইনি এক পরম নৈর্ব্যক্তিক অসীম সত্তা। মর্ত্যধূলির ঘাসে ঘাসে তাঁর আবির্ভাব। ‘ওই মহামানব আসে’। এই ‘মহামানব’- ই ‘THE MAN’. ইনিই সমগ্র মনুষ্যত্ব বা মানবাত্মার মূর্ত প্রতীক। তিনি অন্তরে প্রবলভাবে বিশ্বাস করতেন, “আমাদের অন্তরে এমন কে আছেন যিনি মানব অথচ যিনি ব্যক্তিগত মানবকে অতিক্রম করে ‘সদা জনানাং হৃদয়ে সন্নিবিষ্টঃ’। তিনি সর্বজনীন সর্বকালীন মানব।”
খাঁচার পাখিকে যেমন দূর দিগন্তবিস্তৃত বনের অসীম মুক্ত পাখির সঙ্গে মিশিয়ে দিতে চেয়েছিলেন তেমনি মনের মধ্যে মনের মানুষের অন্বেষণ করতে চেয়েছিলেন কবি। এ এক আত্মিক উপলব্ধি, যাকে বাদ দিয়ে মানুষের উন্নতি বা মুক্তিলাভ কোনোভাবেই সম্ভব নয়। বাউলের কণ্ঠে অল্পবয়সেই তিনি শুনেছিলেন,
‘আমি কোথায় পাবো তারে
আমার মনের মানুষ যে রে’।
হারায়ে সেই মানুষে তার উদ্দেশ্যে
দেশ- বিদেশে বেড়াই ঘুরে’।
—এই গানে তাঁর মন উতলা হয়েছে, পরে বাউলের গানেই তিনি পেয়েছেন সেই রহস্যের সমাধান— ‘মনের মধ্যে মনের মানুষ করো অন্বেষণ’। ‘মানুষের ধর্ম’ প্রবন্ধে তিনি লিখছেন, “মানুষকে বিলুপ্ত করে যদি মানুষের মুক্তি, তাহলে মানুষ হলুম কেন”? মানবিক সত্য বা মূল্যবোধের মধ্যে দিয়ে মনুষ্যত্বের যথার্থ বিকাশ, ভাবের মধ্যেই আমাদের প্রকৃত মুক্তি। ভূমির মধ্যে ভূমা, সীমার মধ্যে অসীম সত্যের সন্ধান লাভ করেছিলেন কবি। যা তাঁর দর্শনকে এক স্থির ও উজ্জ্বল প্রত্যয় দান করেছে। যুগ যুগ ধরে বিভিন্ন যুগাবতাররা আবির্ভূত হয়ে মানুষের অন্তর্নিহিত শক্তির জাগরণের কথা বলেছিলেন। নানা দেশ ও নানা জাতির বিবিধ ও বিচ্ছিন্ন মানুষের অদ্বৈত সত্তার কথা বলেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের ভাবনা বা চিন্তায় বাস্তব পৃথিবীর বস্তুরূপের অন্তরালে এক অধ্যাত্মলীলা বা অতীন্দ্রিয় শক্তির প্রকাশ প্রত্যক্ষ করা যায়। এই শক্তির জোরেই তিনি পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের মানুষের সঙ্গে সহজ সংযোগ রক্ষা করতে পেরেছিলেন। তাঁর চোখে সাধারণ বা প্রত্যক্ষ বিষয় বা বস্তু অন্যভাবে ধরা পড়েছিল — ‘আমার চেতনায় পান্না হলো সবুজ, চুনি উঠল রাঙা হয়ে’।
কঠিন সময়ের মধ্যে জন্ম হয়েছিল রবীন্দ্রনাথের। দেশ- বিদেশের ভয়ংকর সংকট তিনি প্রত্যক্ষ করেছিলেন চোখের সামনে। মানুষের ভাবনা চিন্তার দৈন্যতা তাঁকে ভেতরে ভেতরে মূহ্যমান করে তুলেছিল। রবীন্দ্রনাথ এই সংকীর্ণ ধর্মবোধকে মেনে নিতে পারেননি। ‘পরিশেষ’ কাব্যগ্রন্থের “ধর্মবোধ” কবিতায় তিনি লিখলেন,
“ধর্মের বেশে মোহ এসে যারে ধরে
অন্ধ সে জন মারে আর শুধু মরে”।
মোহ থেকে মুক্তিকামনাই ধর্মের সাধারণ লক্ষণ হওয়া উচিৎ বলে রবীন্দ্রনাথ মনে করতেন। মনুষ্যত্বের বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের আত্মা বা বোধের উন্নতি ঘটে। ধর্ম মোহমুক্ত হতে থাকে। সৃষ্টির জগতেই স্রষ্টাকে সার্থক করে পাওয়া যায়। এইজন্য কোনও মন্দির, দেবালয় বা উপাসনা ক্ষেত্রের দরকার নেই। মানুষের হৃদয় মনুষ্যত্বের সব থেকে বড়ো আসন। আচার আচরণ মানুষকে আরও ক্ষুদ্র করে তোলে। ‘মানুষের ধর্ম’ প্রবন্ধে তিনি লিখলেন, “অত্যাচারীরা সামাজিক কৃত্রিম বিধির দ্বারা যখন খণ্ডতার সৃষ্টি করে তখন কল্যাণকে হারায়, তার পরিবর্তে যে কাল্পনিক পদার্থ দিয়ে আপনাকে ভোলায় তার নাম দিয়েছে পুণ্য। সে পুণ্য আর যাই হোক সে শিব নয়। সেই সমাজবিধি আত্মার ধর্মকে পীড়িত করে। … আত্মার লক্ষণ হচ্ছে শুভবুদ্ধি, যে শুভবুদ্ধি সকলকে এক করে”। আত্মার বিকাশ বা প্রসারতা প্রতিটি ধর্মসাধনার সাধারণ লক্ষণ।
আজ আমাদের সামনে মুক্তিপথের অগ্রদূত রূপে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নেই। তাঁর মৃত্যুর পর ষাটের দশকে রাজনৈতিক অশান্তিতে পিষ্ট হয়েছে গোটা বাংলাদেশ। দেশভাগ, বেকার সমস্যা, সাম্প্রদায়িক হানাহানি, খাদ্য সংকট মানুষকে শান্তি দেয়নি। সৃষ্টি হয়েছে চরম নৈরাজ্য। প্রতিবাদ, প্রতিরোধ করার মতো শক্তির বড়ো অভাব। এমনকি ঋষি বা মনীষীদের সান্ত্বনা বাক্যও অর্থহীন হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এই সময়ে আল মাহমুদ তাঁর ‘রবীন্দ্রনাথ’ কবিতায় লিখেছিলেন,
“শুনুন, রবীন্দ্রনাথ আপনার সমস্ত কবিতা
আমি যদি পুঁতে রেখে দিনরাত পানি ঢালতে থাকি
নিশ্চিত বিশ্বাস এই, একটিও উদ্ভিদ হবে না
আপনার বাংলাদেশ এরকম নিষ্ফলা, ঠাকুর !”
রবীন্দ্র জন্মদিন সাড়ম্বরে পালিত হয়, কিন্তু দিন দিন লোভ আর ভোগবাদের কবলে মানুষ তাঁর ব্যক্তিসত্তাকে বিসর্জন দিচ্ছে। দেশের মধ্যে, আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে সংকট, সংঘাত অব্যাহত ও ঘনীভূত হচ্ছে। একটা পৈশাচিক উল্লাস আর আদিম তাড়নায় মানুষ মানুষকে অবলীলায় হত্যা করছে। সেই যে বিশ্বযুদ্ধ মানুষের চোখের সামনে মহামৃত্যুর শ্মশান রচনা করেছিল তারপর থেকে মানুষের মনের মধ্যে থেকে পাপ- পুণ্য, বিবেক, মনুষ্যত্ব, জন্মান্তরবাদ সব ক্রমশ ক্লিশে হয়ে গেছে। ভাই- বোন- বাবা- মা ইত্যাদি সামাজিক সম্পর্ক ফিকে হয়ে যাচ্ছে। শিক্ষালয়ে শিক্ষকের কদর নেই, সমাজে বিচক্ষণ মানুষের সম্মান নেই, চিকিৎসালয়ে চিকিৎসকের মূল্য নেই। অর্থই আজ গোটা সমাজের নিয়ন্ত্রক হয়ে দাঁড়িয়েছে। ধর্মকে কেন্দ্র করে মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে বিভেদের রাজনীতি। ব্যক্তিস্বার্থের সামান্যতম মতান্তর বা মনান্তর ঘটলে মৃত্যুই হয়ে দাঁড়াচ্ছে তার ভয়াবহ পরিণতি। লোভ, লোলুপতা, ব্যক্তিস্বার্থ, ভোগবাদ, ক্ষমতায়ন, এই সমস্যা শুধু আজ শুধু দেশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, গোটা মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ জুড়ে এই সমস্যা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে ভয়ংকরভাবে। দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে গাজা, ইরাক, লিবিয়া, সিরিয়া জুড়ে। একাধিক জঙ্গিগোষ্ঠী, উগ্রপন্থী বিচ্ছিন্নতার পরিকাঠামো বজায় রাখতে মরিয়া। মধ্যপ্রাচ্যে আইসিস জঙ্গি, দক্ষিণ আমেরিকায় বোকোহারাম গোষ্ঠীর অতর্কিত হামলা আগুনে দিয়েছে ঘৃতাহুতি। বিভিন্ন দেশের মধ্যে সীমান্তসমস্যা প্রবল আকার ধারণ করছে। রাজনৈতিক টানাপোড়েনে স্বদেশ, স্বজনহারা মানুষ আজ খোলা আকাশের নীচে দিন কাটায়। মায়ানমারে নিধন করা হয় রোহিঙ্গাদের, ইউরোপ জুড়ে শরণার্থীরা নিশ্চিন্ত আশ্রয়ের জন্য ছুটে বেড়ায় এদেশ থেকে ওদেশে। মাটিহারা মানুষের এই দুর্দশাও আজ পণ্যায়ন হয় ইলেক্ট্রনিক্স মিডিয়ায়। যা সভ্যতার অত্যন্ত কলুষিত ও বিষাক্ত দিককেই তুলে ধরে।
নারীনির্যাতন, ধর্ষণ, হত্যা তো আজ সাধারণ ব্যাপার। সিঙ্গুর, কামদুনি থেকে শুরু করে শ্বশুরঘরে আজও নারীরা নিয়ত লাঞ্ছনার শিকার। অ্যাসিডে ঝলসে যায় তাদের শরীর। সভ্যতার এই বিকৃত চেহারা দেখে ভয়ে শিউরে হতে উঠতে হয়। প্রকাশ্যে হাজার হাজার শিশুহত্যা ঘটে সিরিয়ায়। ধর্মের নামে চলে শঠ ও ষড়যন্ত্রের লীলা। বিচারের নামে চলে প্রহসন। ব্যক্তি স্বাধীনতা আজ অর্থহীন। গণতন্ত্রের কণ্ঠরোধ করা হচ্ছে। রাতের অন্ধকারে খুন হয়ে যাচ্ছে নির্ভীক সাংবাদিক কিংবা বিবেকবান মানুষ। এই পরিস্থিতিতে রবীন্দ্রনাথের মতো দূরদর্শী মনীষীর বড়ো প্রয়োজন। যিনি ব্যক্তিগত প্রয়োজনের ঊর্ধ্বে উঠে মানুষকে সম্মান দিতে পারেন। যিনি লোকহিতের কথা বলেন। শিক্ষার জন্য গলা মেলান। ‘চিত্রা’ কাব্যের ‘এবার ফিরাও মোরে’ কবিতায় লিখেছেন, এইসব ‘মূঢ় ম্লান মূক মুখে দিতে হবে ভাষা’। তাই প্রয়োজন আরও বেশি রবীন্দ্রচর্চার, আরও বেশি রবীন্দ্র-গবেষণার। একালেও তিনি সমান প্রাসঙ্গিক। তিনি কেবল নিজের জন্য নন, তিনি অভয় দিয়ে আমজনতার পাশে এসে দাঁড়াতে পারেন। উচ্চকণ্ঠে তাদের কানে শোনাতে পারেন,
সেতারেতে বাঁধিলাম তার
গাহিলাম আরবার-
মোর নাম এই বলে খ্যাত হোক, আমি তোমাদেরই লোক
আর কিছু নয়,
এই হোক শেষ পরিচয়। [“পরিচয়”, সেঁজুতি]।
মানুষের প্রতি ভালোবাসা ও তাদের সঙ্গে একাত্মবোধ সমগ্র রবীন্দ্র দর্শনের প্রধান সুর।
তথ্যসূত্র:-
- অরুণকুমার বসু (সম্পা), রবীন্দ্রপ্রসঙ্গ, পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি, পরিমার্জিত সংস্করণ ১৯৯৭।
- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ‘রবীন্দ্র-রচনাবলী’, সুলভ সংস্করণ, প্রথম খণ্ড, বিশ্বভারতী, কলকাতা-১৭, বৈশাখ ১৪০৯।
- তদেব, দ্বিতীয় খণ্ড।
- তদেব, তৃতীয় খণ্ড।
- তদেব, চতুর্থ খণ্ড।
- তদেব, পঞ্চম খণ্ড।
- তদেব, ষষ্ঠ খণ্ড।
- তদেব, সপ্তম খণ্ড।
- তদেব, অষ্টম খণ্ড।
- তদেব, নবম খণ্ড।
- তদেব, দশম খণ্ড।
- তদেব, একাদশ খণ্ড।
- তদেব, দ্বাদশ খণ্ড।
- প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়, ‘রবীন্দ্রজীবনী ও রবীন্দ্রসাহিত্য-প্রবেশক, প্রথম খণ্ড, বিশ্বভারতী গ্রন্থনবিভাগ, কলকাতা, পৌষ ১৩৯৫।
- তদেব, দ্বিতীয় খণ্ড।
- তদেব, তৃতীয় খণ্ড।
- তদেব, চতুর্থ খণ্ড।
