Sunday, November 23, 2025

বাংলায় চৈতন্য প্রভাবে ধর্ম , সমাজ ও সংস্কৃতিক বিপ্লব

অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়

         বাংলা তথা বাঙালির সমাজ , ধর্ম এবং সংস্কৃতিকে যিনি সম্পূর্ণ এক নতুন ধারায় প্রবাহিত করে লুপ্ত হয়ে যাওয়ার থেকে বাঁচিয়েছিলেন তাঁর মনন ও মনীষার উৎকর্ষতার মধ্য দিয়ে তিনি বাঙালির একান্ত গৌরাঙ্গ শ্রীচৈতন্যদেব ৷ আজ থেকে যদি আমরা ছয় শত বছর পিছিয়ে যাই তবে এই বাংলায় সে সময় ব্রাহ্মণ্যবাদের কঠোর পেষণ , সামাজিক ঘৃণা , অবজ্ঞা , বিদ্বেষ , সর্বোপরি অমানবিক আচরণে ব্রাত্য অবহেলিত অধিকারহীন হিন্দু সমাজের এক বৃহত্তর অংশ শিষ্ট সমাজের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েছিল ৷ ফলে নিন্মবর্ণের হিন্দু সমাজের একাংশ ইসলামের প্রতি আনুগত্য দেখিয়েছিল ৷ (বঙ্কিম রচনাবলী — যোগেশ চন্দ্র বাগল সম্পাদিত , ২য় খণ্ড , পৃ ২৯৩ ) এর ফলে বাংলার মুসলমানের সংখ্যা গাণিতিক হারে বৃদ্ধি পেতে থাকে ৷ (বঙ্গে বৈষ্ণব ধর্ম — রমাকান্ত চক্রবর্তী , পৃ. ২৬ ) এদেশে ইসলাম জনসংখ্যার অধিকাংশটাই যে ধর্মান্তরিত হিন্দু সমাজের অংশ , সমাজবিজ্ঞানীরা তা স্বীকার করেছেন ৷ ( Hinduism and Islam in Mediaeval Bengal — E.C. Dimock , P- 10 ) এ সম্পর্কে অবশ্য স্মৃতিকারেরা ছিলেন সম্পূর্ন ঊদাসীন ৷ ধর্মান্তর রোধ করার জন্য সেদিন তারা কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেন নি ৷ মধ্যযুগে হিন্দু শিষ্টবর্গীয়দের একটি ধারা যাগ যজ্ঞ , পূজার্চনা ও ধর্মীয় ক্রিয়াকান্ড নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন এবং শাস্ত্রচর্চায় সময় অতিবাহিত করতেন ৷সমাজে এঁদের প্রভাব ছিল অপরিসীম ৷ সাধারণ মানুষ এঁদের যেমন ভক্তি করতেন তেমনি ভয়ও করতেন ৷ ফলে সাধারণ মানুষের সাথে স্বাভাবিক যোগাযোগ ব্যাহত হত , বিশেষ করে শুদ্ররা সমাজে একেবারে ছিল অপাংতেয় ৷ ফলে সমাজে যে দ্রুত অবক্ষয় চলছে তা বোঝার ক্ষমতা এই বাংলার স্মৃতিকারদের ছিল না ৷ বুঝেছিলেন চৈতন্যদেব ৷ মধ্যযুগে জন্মেও তিনি ছিলেন আধুনিক , কুসংস্কারহীন এবং মুক্ত মনের মানুষ ৷ মানবতার অপমানের বিরুদ্ধে তিনি প্রতিবাদ করেছিলেন ৷ সামজিক অচলায়তনকে ভেঙে দিয়েছিলেন , জাড্যতাকে আঘাত করেছিলেন ,বর্ণভেদের কঠোরতার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিলেন ৷ অন্ত্যজ শ্রেণির মানুষকে কোলে ঠাঁই দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন মানবাত্মার অপমান তাঁর অভিপ্রেত নয় ৷ বৈষ্ণব কবির লেখায় পাই , —ব্রাহ্মণে , চণ্ডালে করে কোলাকুলি , কবে বা ছিল এ রঙ্গ ৷ (চৈতন্যদেব — মৃত্যুজ্ঞয় মণ্ডল . নবদ্বীপ লীলা ,পৃ ১৮—১৯ ) যে সময় বাংলায় শ্রীচৈতন্যদেব জন্ম গ্রহণ করেন ঠিক সে সময়কালে বাংলাতে রাজনীতি , অর্থনীতি , সমাজ ও সংস্কৃতির মধ্যে এক কালো মেঘ বাসা করেছিল ৷ বাঙালি এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য ক্রমাগত ব্যস্ত থাকছিল ৷ এ সময় দরকার ছিল শান্তি , সাহস এবং প্রেম ৷ `প্রেম পৃথিবীতে একবার মাত্র রূপ গ্রহণ করিয়াছিল , তাহা বঙ্গদেশে “—দীনেশ চন্দ্র সেনের এই উক্তি অনেকের কাছে অতিশয়োক্তি মনে হতে পারে ৷ কিন্তু আপামর বাঙালি জনসাধারণ এককথায় মেনে নেবেন যে , চৈতন্যদেব প্রেমের অবতার , মহাভাবের জীবন্ত বিগ্রহ ৷ এই সন্ন্যাসী বাঙালি , বাংলা সাহিত্য , বাংলার শিল্পকলা , চিত্রশিল্প ও সংস্কৃতিকে এতটাই প্রভাবিত করেছিল যে বৌদ্ধ পরবর্তী যুগে এখনও পর্যন্ত চিরবিদ্যমান ৷তাঁর অমৃতময় জীবনের স্পর্শে বাঙালি জাতির জাগরণ ঘটেছিল ৷`বাঙালি যেন এক নতুন জাতি রূপে জন্মলাভ করলো ৷এক মহামানবের চরণাঙ্কিত সরণি নরনারীকে মানবতার পথে বহুদূর পর্যন্ত অগ্রসর করে দিল ৷ বাংলাদেশের এক জটিল রাজনৈতিক ও সামাজিক আবর্তের মধ্যে চৈতন্যদেবের জন্ম ৷ তাঁর পূর্বকালে এবং সমকালেও একদিকে মুসলমান শাসনের নিষ্ঠুরতা , অন্যদিকে হিন্দুসমাজের বর্ণভেদ , জাতিভেদ , সম্প্রদায়গত ভেদাভেদ বাঙালি জীবনকে অতিষ্ঠ করে তুলেছিল ৷ মানুষের সামনে তেমন কোনো আদর্শ ছিল না ৷ এই পরিস্থিতিতে চৈতন্যের প্রেমের বাণী মানুষকে বাঁচার নতুন পথ দেখালো ৷সমস্ত ভেদাভেদ ভুলে মানুষকে কেবল মানুষরূপে গ্রহণ করার কথা তিনি বললেন ; স্পৃশ্য —অস্পৃশ্য , ধনী—দরিদ্র, হিন্দু —অহিন্দু সকলকে কাছে টেনে নিলেন ৷তাই যবন হরিদাসের মতো মানুষও তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহন করেন ৷ জগাই —মাধাই এর মতো দুর্বৃত্তদের তিনি করলেন উদ্ধার ৷ নবদ্বীপের কাজি নাম—সংকীর্তনের উপর যে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিলেন তার বিরুদ্ধে চৈতন্যদেব অবরোধ গড়ে তোলেন এবং তাঁকেও মানবপ্রেমের আদর্শে অনুপ্রাণিত করেন ৷ বস্তুত এর পর থেকে সামাজিক জীবনে হিন্দু মুসলিম ঐক্য সমেত একটি স্থিতাবস্থা দেখা যায় যা বাঙালিকে আবার শিল্পকলা মূখী করে তোলে ৷ আর এই শিল্প ও চিত্রকলার প্রধান বিষয়ও তিনি নিজে শ্রীচৈতন্যদেব হয়ে ওঠেন ৷ বাঙালায় নতুন আঙ্গিকের এই শিল্প ও ভাষ্কর্যে মন্দির গঠন হওয়ার প্রয়োজন হয়েছিল এবং সেখানেও তিনি কৃষ্ণ অবতার রূপে প্রতিভাত হলেন ৷

‌ বিশিষ্ট গবেষক ও সুপণ্ডিত ড. গোলাম মুরশিদ শ্রীচৈতন্যের কর্মপদ্ধতি সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন — “চৈতন্যদেব একদিকে বহু শতাব্দী ধরে নির্মিত জাতিভেদের দুর্ভেদ্য প্রাচীরে প্রচণ্ড আঘাত দিয়ে হিন্দু সমাজে প্রেম ও সাম্যের বাণী প্রচার করেছিলেন , অন্যদিকে ধর্মের মধ্যে শাস্ত্রের কচকচানি নয়, ভক্তি ও আবেগের জোয়ার বইয়ে দিয়েছিলেন ৷ সত্যি বলতে কি , তিনি তাঁর ধর্ম পালনের জন্য কোনো মন্ত্রতন্ত্র আওড়াতে বলেননি ৷ তিনি কেবল নাম কীর্তনকেই তাঁর আনুষ্ঠানিক ধর্মের প্রধান অনুষ্ঠানে পরিণত করেছিলেন ৷আর বলেছিলেন জীবে দয়া করতে ৷তাঁর ছিল অসাধারণ আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব এবং সঙ্গীদের উপর সীমাহীন প্রভাব ৷” মহাপ্রভু জাতিভেদের দুর্লঙ্ঘ প্রাচীর অতিক্রম করেছিলেন ৷ সমাজে প্রায় সকল স্তরে তাঁর বাণী গ্রহণযোগ্য হয়েছিল ৷ প্রেম—ধর্ম ও হরিভক্তিতে যবন হরিদাস ব্রাহ্মণদের অপেক্ষা অনেকাংশে শ্রেষ্ঠ ছিলেন ৷ঐতিহাসিকরা বলেন , বিপ্লব প্রথমে চিন্তাক্ষেত্রে উদয় হয় , পরে তা ব্যবহারিক কর্মক্ষেত্রে অবতীর্ণ হয় ৷ আবার , প্রাচীন ও মধ্যযুগে বিপ্লবের ধারা ধর্মের নামেই প্রকট হয়েছে ৷বাংলাতে চৈতন্য — প্রবর্তিত আন্দোলন সেই পন্থাবলম্বন করেছিল ৷ ফলে ক্রমশঃ শিল্প ও ভাষ্কর্যে স্বাধীন চিন্তা ভাবনার প্রয়োগে সাহস বৃদ্ধি পেয়েছে ৷ঐতিহাসিক এনামূল হক এক জায়গায় বলেন বৈষ্ণব ধর্ম আন্দোলন ও ইসলামের সুফী আন্দোলন একই সরলরেখায় এগিয়ে চলেছিল ৷ আজিজ আহমেদ বলেন —আসলে চৈতন্যদেবের আন্দোলন ছিল ইসলামের বিরুদ্ধে ইসলামের ধর্মান্তরিতকরণের বিরুদ্ধে এক প্রতিবাদ বা প্রতিদ্বন্দ্বিতা ৷ এখানে চৈতন্যদেব বিশ্বজনীন ধর্মের কথা বলেন , সর্বেশ্বরবাদের কথা বলেন , সকলেই সমান — মানদণ্ডে অবস্থানকারীর কথা বলেন ৷ নাম—গান—সংকীর্তন যে কেউ করতে পারবে , এর মাধ্যমেই মোক্ষ পাওয়া যাবে , ইসলামে যাওয়ার দরকার নেই , এখানেই মোক্ষ পাওয়া যাবে ৷ জালালউদ্দিন রুমি বলেন — এইভাবে দেখা যায় যেখানে সুফী সামা আদি মধ্যযুগে বাংলায় জনপ্রিয় হতে পারেনি, সেখানে নাম সংকীর্তন জনপ্রিয়তা পায় ৷ তাছাড়া চৈতন্যচরিতামৃত ও চৈতন্য ভাগবত থেকে জানা যায় — মুসলিম ধর্ম থেকে বৈষ্ণবধর্মে ধর্মান্তরিতকরণের প্রথম উদাহরণ হল যবন হরিদাস ৷ তিনি নিজে ধর্মান্তরিত হয়ে অন্যান্য বহু মুসলিমকে , অ-হিন্দুকে এই বৈষ্ণবধর্মে নাম সংকীর্তনে আকৃষ্ঠ করেন , ধর্মান্তরিত করেন ৷তাই এ সময় দেখা যায় —অনেক মুসলিম কবি কৃষ্ণকে নিয়ে লিখেছেন ৷ ২“চৈতন্য প্রভাবে শিল্পে যে নবজাগরণ হয়েছিল বাংলায় তার জন্য সামাজিক কারণটিও বিচার্য ৷ চৈতন্য-ধর্মের একটি বিশেষ দিক হল সমাজে অবহেলিত মানুষের স্বীকৃতি ৷পণ্ডিত , কুলীন , ধনী , চৈতন্যধর্মে তেমন সমাদৃত হয়নি ৷শাস্ত্র —পণ্ডিত তাঁর কাছে আদর পায়নি , অহঙ্কারী পণ্ডিতকে তিনি আমল দেননি ৷ বংশমর্যাদাও তাঁর ধর্মে বড় বলে স্বীকৃত হয়নি ৷ শূদ্রদ্বারেই তিনি ধর্মের গূঢ়তত্ব বর্ষণ করিয়েছিলেন ৷ বিষয় ধনবান লোককে তিনি “কালসর্প ”বলে মনে করেছেন ৷গজপতি প্রতাপরুদ্র থেকেও তাঁর কাছে সমাদৃত হয়েছেন পুরীর আঁখরারিয়া (পুথির লিপিকা ) বিজয় দাস ৷ গৌরাঙ্গদেব খোলাবেচা শ্রীধরের সছিদ্র লৌহপাত্রে জলপান করেছেন, ভিখারী শুক্লাম্বরের ভিক্ষাপাত্র থেকে তন্ডুল ভক্ষণ করেছেন৷ চৈতন্যদেব অবহেলিত মানুষের জন্য নতুন আশ্বাস বহন করে এনেছেন ৷বাংলার রূপদক্ষ শিল্পী সম্প্রদায় যাদের না ছিল প্রতিপত্তি , না ছিল প্রতিষ্ঠা , তারাও চৈতন্যপ্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে উঠেছেন ৷বাংলার স্থাপত্য , ভাষ্কর্য ও চিত্রকলা চৈতন্যস্পর্শে প্রাণের স্ফুর্তিতে বিকশিত হবার সুযোগ লাভ করেছে ৷ ” (জাহ্ণবী কুমার চক্রবর্তী ১৯৮৮:১৫১)
চৈতন্যদেবের জীবিতকালেই তাঁর দারু মূর্তি প্রতিষ্ঠা শুরু হয়েছে ৷শ্রী হরিদাস দাস ৪৪ টি মূর্তির উল্লেখ করেছেন (হরিদাস দাস :৫০১ চৈতন্যাব্দ ) ৷ ইতিহাসবিদ শ্রী তারাপদ সাঁতরাও এ প্রসঙ্গে একটি তালিকাও দিয়েছিলেন তাঁর লেখাতে ৷

চৈতন্যভক্তরা চৈতন্যদেবকে কৃষ্ণের অবতার বলে মনে করতেন , তাই চৈতন্যরূপ বর্ণনায় শ্রীকৃষ্ণের ছায়া , চৈতন্যমূর্তিতে কৃষ্ণমূর্তির ভাব ৷ ৩ ; বঙ্গে চৈতন্যোদয়ের পর সমগ্র সংস্কৃতি জগতে যে ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছিল তার সামাজিক ঐতিহাসিক কারণ আছে ৷পাল যুগ থেকেই বাংলার শিল্পকলার শ্রেষ্ঠ বিকাশ হয়েছিল ৷ “সভ্যতার এই বির্বতনের ফলেই অতীতে বোধহয় বাঙ্গলা মগধ হইতে পৃথক হইয়া নিজের ব্যক্তিত্ব , অর্থাৎ বাঙ্গালীয়ানা বিবর্তিত করিয়াছে ৷ তজ্জন্য বাংলার প্রকৃতিপুঞ্জ গোপাল নামে দাসজীবিন জাতীয় একজন সামন্তকে রাজপদে নির্বাচন করিয়া বাঙ্গালী এক জাতীয়তা বিবর্তিত করে ৷(ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত ) অতীতের এই বিবর্তনকে লেখক বাংলার First Social Integration অর্থাৎ বাংলার সমাজের প্রথম সমীকরণ নামে অভিহিত করেন ৷ আর এই সমীকরণের পর ভারতের চারিদিক হতে বিভিন্ন জাতীয় লোক এই প্রদেশে এসে বসবাস করতে শুরু করে ৷এবং তার সঙ্গে সঙ্গে হিন্দু বাঙালী সমাজেরও বিবর্তন হয় ৷ বিশেষ করে কর্ণটি , কনোজিয়া , উড়িয়া, দাক্ষিণাত্য , পাশ্চাত্য প্রভৃতি প্রাদেশিক মানুষ বাংলা সংস্কৃতিতে একসাথে দ্রবীভূত হয়ে বর্তমানের হিন্দু-বাঙালী তৈরি হয়েছে ৷এই সঙ্ঘবদ্ধতাকে লেখক Second Social Integration অর্থাৎ দ্বিতীয় সামাজিক সমীকরণ নামে অভিহিত করেছেন ৷ চৈতন্যদেবের সময়কালে ভূপেন্দ্রনাথ বর্ণনা অনুযায়ী দ্বিতীয় সামাজিক সমীকরণ ঘটে ৷ এরসঙ্গে এসেছিল অস্পৃশ্যতা জাতিভেদ বিরোধী শ্রীচৈতন্যদেবের প্রেমধর্মের আহ্বান এবং বাংলার বৈষ্ণবসমাজে জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে মানুষকে এক করে দেখার প্রয়াস ৷চৈতন্য সংস্কৃতির প্রভাবে পালযুগের সূচনা থেকে সেনযুগের শেষ পর্যন্ত বাংলার শিল্পকলায় বেশ পরিবর্তন হয় ৷ (কল্যাণ কুমার গঙ্গোপাধ্যায় )৷

ষোড়শ শতক থেকে বাংলায় মূর্তিশিল্প , ভাষ্কর্য ও মন্দির স্থাপত্যের যে সূচনা হল তা প্রত্যক্ষভাবে চৈতন্যদেবের ভক্তি আন্দোলনের ফল তা আগেই উল্লেখ করেছি ৷মূর্তি প্রতিষ্ঠায় আর রাজা জমিদারদেরই শুধুমাত্র অধিকার এমনটা থাকলো না ৷সাধারণ ভক্তজন , ছোট বড় ব্যবসায়ী , বড় চাষী , তন্তুবায় , বণিক ,ছোট রায়তদার , জমিদার কর্মচারী সকলেই এগিয়ে এলো , সবার সমান অধিকার এই মত প্রতিষ্ঠিত হল ৷ এ সময় অবশ্য বিষ্ণুপুরের মল্লরাজারা বা পরবর্তীতে বর্ধমানের জমিদাররা যাদের বিত্ত বা বৈভব পাল বা সেনরাজের তুলনায় অনেক অনেক কম তারাও বৈষ্ণব শিল্পের প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতা করেছে ৷ পুর্বশিল্পের সাথে লোকায়ত শিল্পের ধারা মিশ্রিত হয়ে চৈতন্য পরবর্তী যুগে যে নতুন শিল্পের জন্ম দিল তা নিখাদ বাঙালি জীবনচর্চা ৷ এখানে শিল্পী শ্রীকৃষ্ণকে প্রত্যক্ষ করেছে চৈতন্যদেবের মধ্য দিয়ে ৷ শ্রীরাধিকাকে বিষ্ণুপ্রিয়ার অঙ্গিকে উপস্থাপনের প্রচেষ্টা দেখা গেছে ৷ মন্দিরের টেরাকোটা প্যানেলে যেমন শোভিত হয়েছে তেমনি তৎকালীন সাহিত্যেও চৈতন্য ও কৃষ্ণের রূপ বর্ননা স্থান পেয়েছে সবার প্রথমে ৷

ইতিহাসবিদ হিতেশরঞ্জন সান্যাল ষোড়শ শতক থেকে ১৯২৬ পর্যন্ত নির্মিত প্রায় ৫০৭ টি মন্দিরের তালিকা তৈরি করেছিলেন ৷এর মধ্যে ১. মহাপ্রভূ /শ্রীগৌরাঙ্গ/গৌর নিতাই /নিতাই গৌর মন্দিরের সংখ্যা ৬৬ ২. মল্লভূমি রাজাদের স্থাপিত মন্দির ৩২ এবং ৩. বিশিষ্ট বৈষ্ণব মন্দির হল ৪০৯ টি ৷ এ তালিকায় অবশ্য উত্তর ও পূর্ববঙ্গের অনেক মন্দির নেই ৷ একটা বিষয় উল্লেখযোগ্য যে এই মন্দিরগুলির যারা প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন তারা জাতিগতভাবে ছিলেন ব্রাহ্মণ , বৈদ্য , ক্ষত্রিয় , ছত্রি , কায়স্থ , সুবর্ণবণিক , জাত বৈষ্ণব ,তাম্বলী, মাহিষ্য ,পাঞ্জাবী-লালা, শোলাঙ্কি , সদগোপ , তন্তুবায়, তেলী, আগুরি, ময়রা, পিতুলীকামার ,তাঁতি ,সরাক, একাদশ তেলী ,শঙ্খবণিক ,গন্ধবণিক, রাজপুত , নমঃশূদ্র , মোদক ,লোহারকামার প্রভৃতি সম্প্রদায়ের ৷ এখানে দেখা যাচ্ছে উচ্চ শ্রেণির পাশাপাশি নিন্মশ্রেণির মানুষ অনেক বেশি বৈষ্ণব মন্দির নির্মানে অংশগ্রহণ করেছিলেন ৷আগেই উল্লেখ করেছি একমাত্র মাঝরি মল্লভূমের রাজারা , বড় জমিদার শ্রেণি বর্ধমানের রাজারা এদের সাথেই টেরাকোটা সম্মৃদ্ধ বৈষ্ণব মন্দির নির্মান করেন , ঐ সময় কিছু বড় ব্যবসায়ীগণ ও মন্দির নির্মান করেন ৷শোনা যায় শ্রীনিবাস আচার্য সিন্দুক ভরা বৈষ্ণব গ্রন্থ উদ্ধর করতে গিয়ে বিষ্ণুপুর রাজসভায় উপস্থিত হন ১৫৯৮ সালে বীর হাম্বিরকে বৈষ্ণবতায় দীক্ষিত করেন ৷ পরবর্তীতে বিষ্ণুপরে টেরাকোটা মন্দির নির্মানে যে জোয়ার আসে তার মূল বিষয় ছিল চৈতন্যপ্রভাবিত ও চৈতন্য আঙ্গিকে শ্রীকৃষ্ণ লীলা ৷ বিষ্ণুপুরের টোরাকোটা অলংকৃত মন্দিরের মধ্যে প্রথম উল্লেখযোগ্য শ্যামরায় মন্দির প্রতিষ্ঠিত হয় ১৬৪৩ খ্রিষ্টাব্দে ৷এর দশ বছর আগে বীরভূমের ঘূড়িয়া গ্রামে রঘুনাথ মন্দিরে যে বৈষ্ণবীয় মোটিফগুলি তা উল্লেখযোগ্য ভাষ্কর্যের একটি নিদর্শন ৷বাঁশবেড়িয়া রাজার নির্মিত অনন্তবাসুদেব মন্দির টিও অপরূপ বৈষ্ণবীয় অঙ্গিকের টেরাকোটা সম্মৃদ্ধ ৷ বাংলার মন্দির স্থাপত্যে ও টেরাকোটায় ষড়ভূজ চৈতন্যমূর্তির দুটি উদাহরণ বিষ্ণুপুরের শ্যামরায় (১৬৪৩) ও জোড়বাংলা (১৬৫৫) মন্দির ৷ষড়ভূজ চৈতন্যমূর্তি রয়েছে মদনমোহন (১৬৯৪) মন্দিরের পুব দেওয়ালের ভিত্তিভূমের প্যানেলেও ৷ বিষ্ণুপুরের মন্দির গুলোতে অলংকরণের ক্ষেত্রে একমাত্র ষড়ভূজ চেতন্যমূর্তি সম্পর্কে শিল্পীরা বেশ দরাজ এছাড়া অন্য কোনো চৈতন্য লীলা এখানে সেভাবে দেখা যায় না ৷ঐ সময়েই আরেক গুরুত্বপূর্ণ মন্দির কেঁদুলির নবরত্ন রাধাবিনোদ মন্দিরে চৈতন্যদেবের একটি ষড়ভূজ মূর্তি আছে ৷গুপ্তিপাড়ার রামচন্দ্র মন্দিরে এবং বংশবেড়িয়ার অনন্ত বাসুদেব মন্দিরে ষড়ভূজ চৈতন্যের প্যানেল আছে , এ মন্দিরে আবার ষড়ভূজ মূর্তির দুপাশে ভক্তরা লুটিয়ে পড়ে প্রণাম করছে এবং আরো কয়েকজন জোড়হাতে প্রণত এমন টেরাকোটার কাজ মুগ্ধ করে ৷বাংলার প্রায় প্রতিটি মন্দিরেই টেরাকোটার ক্ষেত্রে দুটি আঙ্গিক গুরুত্ব পেয়েছে , একটি চৈতন্যদেবের নেতৃত্বে সংকীর্তন দৃশ্য অন্যটি চৈতন্যের সেই ষড়ভূজ মূর্তি ৷ বাংলায় এমন মন্দির প্রায় নেই বললেই চলে যেখানে এদুটি ছবি অনুপস্থিত ৷বিষ্ণুপুরের মদনমোহন বা হুগলির বাঁশবেড়িয়ার অনন্ত বাসুদেব মন্দিরে খোল এবং অন্যান্য বাদ্যবাদন সহ সংকীর্তন ও নাচের নানা মুদ্রা টেরাকোটার প্যানেলগুলোতে দেখা যায় ৷ আবার চৈতন্যের ভাবাবেশে মূর্ছার মূর্তি আছে বাঁকুড়ার হোদলনারায়ণপুরের ছোটোতরফের রাধাদামোদর নবরত্ন মন্দিরে , ইলামবাজারের বামুনপাড়ার লক্ষ্মীজনার্দন পঞ্চরত্ন মন্দিরে ৷ বিশিষ্ট মন্দির বিশেষঞ্জ তারাপদ সাঁতরা এক জায়গায় বলেছিলেন : সতেরো থেকে আঠারো শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত সময়ে সৃষ্ট এমন বহু শিল্পনিদর্শনে চৈতন্য রূপারোপ যত না হয়েছে , পরবর্তী উনিশ শতকের শেষ অবধি বহু শিল্পকলায় চৈতন্যলীলা দৃশ্য একেবারে ছয়লাপ বললেও অত্যুক্তি হয় না ৷ টেরাকোটায় চৈতন্য মূর্তির দুটি দিক এসেছে দুটি ভাবধারার প্রভাবে ৷ একটি বৃন্দাবনের বৈষ্ণবীয় দর্শন যেখানে চৈতন্যদেব শুধুমাত্র ভগবান তুল্য অন্যদিকে নবদ্বীপ ঘরানায় চৈতন্য আন্দোলনের সামাজিক দিকটি গুরুত্ব পেয়েছে ৷ মন্দিরগাত্রে চৈতন্যদেবকে কেন্দ্র করে এই দুই ঘরানার টানাপোড়েন সপ্তদশ শতকের মন্দিরগুলোতে স্পষ্ট ৷ রাধাকৃষ্ণলীলাই ধীরে ধীরে সপ্তদশের মন্দির শিল্পীদের প্রধান নির্ভর হয়ে ওঠে ৷ আবার অষ্টাদশ ও উনিশ শতকের মন্দির টেরাকোটায় চৈতন্যলীলা গুরুত্ব লাভ করে ৷ আবার মন্দির বিশেষজ্ঞ হিতেশ রজ্ঞন সান্যাল বাংলায় বৈষ্ণব মন্দির গুলির যে তালিকা তৈরি করেছিলেন তাতে দেখা যায় সপ্তদশ শতকে চৈতন্য মন্দির নির্মিত হয়েছে একমাত্র বীরভুমের ময়নাডালে ৷ তাঁর পরিসংখ্যান অনুযায়ী অষ্টাদশ শতকেও চৈতন্য মন্দিরের সংখ্যা এমন উল্লেখযোগ্য ছিল না কিন্তু উনিশ শতকে এসে গৌরাঙ্গ মন্দিরের বাড়বাড়ন্ত চোখে পড়ে ৷তেমনি টোরাকোটায় চৈতন্যজীবনের ঘটনাবলী আবার মূখ্য বিষয় হয়ে ওঠে ৷উপাস্য দেবতা হিসেবেও গৌরনিতাই এবং গৌরের একক বিগ্রহ প্রধানত চোখে পড়ে , কাটোয়ার গৌরাঙ্গপাড়ায় ষড়ভূজ মন্দির বা পাঁচরোলের ষড়ভূজ মহাপ্রভূ মন্দির ইত্যাদি ৷পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের দক্ষিণ দরজার কাছে চৈতন্যের বিশালকায় ষড়ভূজ মূর্তি বিরাজমান ৷ বাংলায় মন্দির টেরাকোটায় অনেক স্থানে চৈতন্যদেবের সপার্ষদ কীর্তন দলের সামনে বাদশাহী সাজে সজ্জিত মানুষটি পুরীর রাজা প্রতাপরুদ্র ৷ দেখা যাচ্ছে বাংলায় চৈতন্য সংস্কৃতি যেমন অন্য ভাবাদর্শ ও মতকে প্রভাবিত করেছে ঠিক তেমনি সাংস্কৃতিক নিরাপত্তা দানও করেছিল , যা সারা প্রবন্ধ জুড়েই আলোচনা করা হল ৷

তথ্য সূত্র— ১.অঞ্জন সেন —বঙ্গশিল্পে চৈতন্য প্রভাব ,দশদিশি ( বিষয় : শ্রীচৈতন্য ) ২.শ্রীলা বসু — বাংলার মন্দির ভাষ্কর্যে চৈতন্যদেব — ( নবজাগরণের প্রথম আলো শ্রীচৈতন্য ) ৩. তারাপদ সাঁতরা , পশ্চিমবঙ্গের মন্দির টেরাকোটা ৷ ৪. মোহাম্মদ শাহনূরুর রহমান —বাংলায় বৈষ্ণবধর্ম ও সংস্কৃতি সমন্বয় , নবজাগরণের প্রথম আলো শ্রীচৈতন্য , সম্পাদনা :সুকান্ত পাল ও সুব্রত রায় ৷ ৫. বিজয় কৃষ্ণ গোস্বামী — ইতিহাসের পায়ে পায়ে  ৷

Scroll to Top