Published on – Sunday, November 23, 2025

শেষবেলায়

তপন বন্দ্যোপাধ্যায়

সবুজ ঝাউয়ের সারির পিছনে মস্ত লাল বিল্ডিং, তার সামনে দিয়ে হুইলচেয়ারে বসে দীপ্তার্ক  খুব ধীরে ধীরে লনের দিকে আসছে এমন একটি দৃশ্য চোখে পড়তে বুকের ভিতর চলকে উঠল স্নেহার৷

গত তিনদিন সে লনে আসতে পারেনি তার নিজের শরীরের প্রবল অবনতি ঘটায়৷ তিনদিন আগে কেমো নিতে গিয়েই হঠাৎ কেঁপে–কেঁপে উঠছিল তার সমস্ত শরীর, কিছুক্ষণের জন্য মনে হয়েছিল নিশ্বাস বন্ধ হয়ে গিয়েছে তার৷ ডাক্তার ফরমান জারি করেছেন একদম বেডরেস্ট৷ তার আগে দীপ্তার্র্কও দুদিন আসতেপারেনি তার শরীর খারাপ ছিল বলে৷ তাই আজকের এই সাক্ষাৎ স্নেহার কাছে খুবই কাঙক্ষণীয়৷  

বিকেলের এই সুন্দর মুহূর্তটির জন্য সে গত দু–মাস ধরে প্রতিদিন অপেক্ষা করে একবুক ব্যাকুলতা নিয়ে৷ কিন্তু রোজ তো দেখা হয় না কোনও দিন তার শরীর খারাপ থাকে, কোনও দিন দীপ্তার্কর৷  বেশ কয়েকদিন পরে দেখা হচ্ছে বলে আজ খুবই তীব্র আকুতি বোধ করছে সে৷ কিন্তু অপেক্ষার এই মুহূর্তগুলো যেন অন্তহীন৷ দীপ্তার্ক  খুব ধীরে ধীরে, এক–পা এক–পা করে আসতে পারে৷ কিন্তু পা তো নয়, সে তো বসে আছে হুইলচেয়ারে, সেই হুইলচেয়ারের চাকা এগোয় যেন পায়ে–পায়ে৷ কেন না পরমার্থর পায়ে কোনও জোর নেই, ক্রমশ কমে আসছে তার হাতের জোরও৷ শুধু হাত বা পা–ই নয়, তার সমস্ত শরীরেই ক্ষয় চলছে দ্রুত৷ ক্ষয় কিংবা পচন৷

কতই বা বয়স দীপ্তার্কর চব্বিশ বা পঁচিশ৷ এই বয়সে তার বাইক নিয়ে দাপিয়ে বেড়ানোর কথা৷ পরিবর্তে তার বাহন হুইলচেয়ার৷

হাসপাতালের ওয়ার্ড থেকে একজন হেল্পার সঙ্গে আসার কথা, কিন্তু তাদের আসার কোনও ঠিকঠাকানা নেই৷ অনেক সময় দীপ্তার্র্ক অপেক্ষা করে দেখেছে তাদের কেউ এলই না৷ বাধ্য হয়ে দুর্বল শরীরে সে নিজেই চালাতে সুরু করে হুইলচেয়ারের চাকা৷ সামান্য এই পিচপথটুকু পেরোতেই তার সময় লাগে বহুক্ষণ৷ হাঁপিয়েও যায় প্রচণ্ড৷ তাতেও তার উৎসাহের অন্ত থাকে না, কেন না সে জানে তার জন্য অপেক্ষা করে আছে স্নেহা৷

প্রতিদিন মাত্র একঘন্টা সময় তাদের বরাদ্দ থাকে এই লনটিতে বেড়ানোর৷ যে সব পেশেন্টদের অনেকদিন কোনও ভিজিটর আসে না, বাইরের জগতের সঙ্গে সংযোগ শেষ হয়ে আসছে ক্রমশ, তাদের অনেকেই হাসপাতালের লনে চলে আসে বিকেলের এই রোদ–নিবে–আসা মুহূর্তে, একটি ঘন্টা কাটিয়ে যায় পারস্পরিক দেখাশোনা ও কথাবার্তায় নিজেদের কিছুটা উজ্জীবিত করে নিতে৷

লনটা সত্যিই সুন্দর, গাঢ় সবুজ ঘাসের আস্তরণ ঠিক যেন ভেলভেটের মতো নরম, চকচকে, স্নিগ্ধ৷ দীপ্তার্র্ক পৌঁছোলে সেই সবুজের ঘনত্ব যেন আরও চমৎকার হয়ে দেখা দেয় স্নেহার চোখে৷ হুইলচেয়ারটি থামতেই স্নেহা ঝুঁকে পড়ে তার শরীরের উপর, আজ যেন একটু ফ্রেশ দেখাচ্ছে?

দীপ্তার্র্ক মৃদু হাসে, যেন শব্দ করে হাসতেও এখন কষ্ট হয় তার, বলল, তোমাকে দেখলে রোজই আমার ফ্রেশনেস একটু করে বেড়ে যায়, স্নেহ৷

কুড়ি পেরিয়ে একুশে পা দেওয়ার পথে স্নেহা, তাকে স্নেহা না বলে দীপ্তার্র্ক তাকে স্নেহ নামে ডাকতে ভালোবাসে, বলে, তোমার নাম কে রেখেছিল জানি না, কিন্তু তোমার চাউনির মধ্যে সারাক্ষণ টলটল করে স্নেহ৷ তোমার দৃষ্টির মধ্যে কী এক আশ্চর্য মেদুরতা কী সুশীতল তোমার সান্নিধ্য৷

হুইলচেয়ারটির চলন থামিয়ে আজ বলল, কেমো নিয়ে তোমার শরীর খারাপ হয়েছিল?

স্নেহা হালকা স্বরে বলে, ওই একটু৷ ডাক্তার বললেন ক–দিন রেস্ট, তাই এ ক–দিন আসতে পারিনি৷ এটা নিয়ে তিনটে হল৷ আরও তিনটে বাকি৷

––কেমো নেওয়ার সময় খুব কষ্ট হয়, তাই না?

স্নেহা চেপে যায় আগের দিন কেমো নেওয়ার সময় তার শরীর খুব খারাপ লাগছিল৷ যে–ডাক্তার কেমো দেওয়ার সময় উপস্থিত ছিলেন, তিনি নিজেও বেশ টেনসনে পড়েছিলেন স্নেহার অস্থিরতা লক্ষ করে৷ দীপ্তার্র্ককে আশ্বস্ত করতে বড়ো করে ঘাড় নাড়ে, না তেমন কষ্ট আর কী হাতে তো সারাক্ষণ একটা চ্যানেল করাই আছে৷ ওষুধটা চ্যানেলের ভিতর দিয়ে শরীরে প্রবেশ করার সময় একটু অস্বস্তি হয়, এই যা৷ বিষ ঢুকছে না?

দীপ্তার্র্কর নজর পড়ল স্নেহার মণিবন্ধের ঠিক নীচে একটা ছোট্ট ব্যান্ডেজ, তার মধ্যে সারাক্ষণ একটা চ্যানেল, সেই পথ দিয়ে যাবতীয় অ্যাম্পুলের তরল প্রবেশ করে তার রক্তের মধ্যে৷ রোজই গুচ্চের ইঞ্জেকশন আর ট্যাবলেটের মধ্যে জীবনধারণ স্নেহার৷

স্নেহা বলে, ‘এখন জীবনধারণ মানে বিষধারণ৷’ সেই বিষের এক–একটা অ্যাম্পুলের দাম অনেক৷ দীপ্তার্র্ককে বলেছে স্নেহা, তার মধ্যবিত্ত বাবা কীভাবে নিজের প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা শূন্য করে তাকে নিয়ে মুম্বই পর্যন্ত ছোটাছুটি করেছেন, তারপর এখন হাল ছেড়ে দিয়ে রেখেছেন এই হাসপাতালে৷ বাকি যে–কদিন বাঁচবে, এখানেই––  

স্নেহা তার মাথায় বাঁধা কালো ওড়নাটা টেনে নেয় আর একটু৷ কেমোথেরাপির এটা দ্বিতীয় পর্যায়, বছর খানেক আগে মুম্বই গিয়ে ছ–টা কেমো নেওয়ার পর বেশ ভালো ছিল তার শরীর৷ যখন মনে হচ্ছিল হয়তো সেরেই গেছে তার অসুখটা, ঠিক সেই সময় হঠাৎ রিল্যাপ্স করল তার বুকের টিউমারটা৷ দ্বিতীয় পর্যায়ে কেমো শুরু করার পর থেকে আবার উঠে যাচ্ছে তার মাথার সুন্দর, কোঁকড়ানো চুলগুলো৷ প্রায় কেশহীন হয়ে পড়েছে তার মাথা, ঠিক যেমনটি হয়েছিল আগেরবার৷ একটা কালো ওড়না দিয়ে ঢ়েকে রাখতে হয় এ সমটা৷

––তোমার শরীর ঠিক আছে তো এখন? দীপ্তার্র্কর স্বরে প্রায় কাতরধ্বনি৷ স্নেহার সঙ্গে এখানে হঠাৎই আলাপ, লনে আরও পাঁচজনের সঙ্গে যেমন দেখা হয়, মাসদুয়েক আগে তেমনই৷ তারপর দুজন দুজনের কাছে এখন যেন অপরিহার্য৷ 

দীপ্তার্র্কর এই প্রশ্ণের ঠিক কোনও জবাব হয় না, কেন না শুধু ডাক্তারদের চোখমুখ দেখেই স্নেহা অনুমান করতে পারছে তার শরীরের অন্দরমহলে খুব দ্রুত দাঁড়া বাড়িয়ে চলেছে সেই মারণরোগটি৷ সে নিজেও আন্দাজ করতে পারছে প্রতিরোধশক্তি কমে আসছে তার শরীরে৷

কিন্তু স্নেহা তাকে আশ্বস্ত করতে বলল, অনেকটাই কম৷ ডা. বসু বলেছেন এই কোর্সটা যদি নিতে পারি তা হলে আবার কিছুদিন––

দীপ্তার্র্ক অস্থির হয়ে বলল, নিশ্চয় ভালো হয়ে যাবে৷ আজকাল তো সেরে যাচ্ছে এই অসুখ

স্নেহা হাসে, আঙুল দিয়ে লনের একটা নিরিবিলি কোণ দেখিয়ে বলে, চলো, ওখানে গিয়ে একটু বসি৷ ঘাসের উপর বসতে আমার বরাবরই খুব ভালো লাগে৷

বলতে বলতে দীপ্তার্র্কর হুইলচেয়ারটা সে নিজেই ঠেলতে শুরু করে, ঠেলে নিয়ে যায় লনের সেই জায়গায় যেখানে একটি কিশোর কৃষ্ণচূড়া ঝাঁকড়া হয়ে ডালপালা মেলতে শুরু করেছে মহা উল্লাসে, পরম নিরুদ্বিগ্ণতায়৷

হুইচেয়ারটি তার নীচে দাঁড় করিয়ে স্নেহা বলল,  তুমি কি নীচে নামতে পারবে?

––কেন পারব না? দীপ্তার্র্ক উত্তেজনায় কাঁপতে থাকে, তার ভারী পা–দুটো নামাতে চায় নীচে৷ দুটো পা–ই গ্যাংগ্রিনে–গ্যাংগ্রিনে অসম্ভব স্ফীত ও  অতিভার৷ পাজামা পরনে থাকায় বাইরে থেকে ঠিক বোঝা যায় না পায়ের পরিমাপ৷ সেই পৃথুলতার কারণে তার পা–দুটো নীচে নামাতে অক্ষম হয় ও অসহায়ভাবে তাকিয়ে থাকে স্নেহার দিকে৷

স্নেহা অনুমান করতে পারেনি কয়েকদিন আগেও যেরকমটি ছিল দীপ্তার্র্কর পা, এই ক–দিনে তার দ্বিগুণ আকারের৷ স্নেহা চেষ্টা করছিল তার পা–দুটো যাতে স্পর্শ করতে পারে লনের ঘাস, কিন্তু তার নিজের শরীরও এখন এমন দুর্বল ও শীর্ণ যে, তার পক্ষে এই বিশাল ভার নামানো অসাধ্য৷ কিছুক্ষণের মধ্যে দুজনেই ঘেমেনেয়ে অস্থির ও  ক্লান্ত৷ স্নেহা দেখছিল নিজের এই অপারঙ্গমতায় দীপ্তার্র্কর মুখচোখ লজ্জায়, হীনমন্যতায় আনত ও রক্তিম৷ হাঁপাচ্ছে অবিরাম৷

স্নেহা নিজেও হাঁপাচ্ছিল প্রবলভাবে, কিন্তু তার নিজের শ্রান্তি লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করে বলল, ঠিক আছে, তুমি বরং চেয়ারেই বসে থাকো, আমি তোমার পায়ের কাছে বসি, যেমন বসি প্রতিদিন৷   

বলতে গিয়ে তার চোখে পড়ল দীপ্তার্র্কর চুলগুলো অন্যদিনের চেয়ে অনেক বেশি এলোমেলো, বিশ্রস্ত৷ বলল, নার্সরা তোমার চুলগুলো একটু ভালো করে আঁাঁচড়েও দেয় না?

দীপ্তার্র্ক তার ডান হাত মাথায় রাখে, তখনও শ্বাস ফেলছে ঘন ঘন, হাসার চেষ্টা করে বলল, আঁাঁচড়ে দেয় মাঝেমাঝে, কিন্তু আমার চুলগুলো বড্ড বেয়াড়া, কিছুতেই বাগ মানতে চায় না

––না, না, আঁাঁচড়ায় না৷ ওরা বুঝতে পারে কারা ভালোমানুষ, চেঁচামেচি করে না, তাদের ওরা অবহেলা করে৷

বলে তার কাঁধে ঝোলানো ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে একটি চিরুনি বার করে অতিযত্নে ঠিক করে দিতে থাকে দীপ্তার্র্কর অবিন্যস্ত চুলের রাশি৷ কালো চুলের গুচ্ছ চিরুনির ডগায় বাগ মানাতে বেশ স্বস্তি পাচ্ছিল স্নেহা৷ তারপর চিরুনিটি পুনর্বার ব্যাগের মধ্যে চালান করে দিয়ে বলল, বাহ্, এবার বেশ ভালোছেলে–ভালোছেলে দেখাচ্ছে৷ এতক্ষণ কীরকম দুষ্টু–দুষ্টু লাগছিল 

দীপ্তার্র্কর মুখ জুড়ে এক অদ্ভুত হাসি, বলল, আগে তো একটু দুষ্টুই ছিলাম কলেজে পড়তে এক বান্ধবীর খাতা লুকিয়ে রাখতাম প্রায়ই৷

স্নেহার হাসি–হাসি মুখ, তাই নাকি?

––হ্যাঁ, তাই নিয়ে একদিন কী রাগারাগি তার বলল, পড়া ছেড়েই দেবে৷

––তারপর কী হল?

––তারপর নাক–কান মুলে বললাম, আর হবে না, ম্যাডাম৷

––তারপর?

––তারপর কমপ্রোমাইজ৷

––তারপর?

––তারপর কলেজের পড়া শেষ করে আমি বিশ্বাবিদ্যালয়ে পড়তে চলে গেলাম, আর সে ঘরসংসার নিয়ে ব্যস্ত৷ আর দেখা হয়নি৷ আমাদের কথাটি ফুরুলো, নোটেগাছটি মুড়োলো৷

––ই––ইস৷

দীপ্তার্কর মুখে আশ্চর্য হাসি, বলল, ইসের কিছু নেই৷ কলেজে পড়তে গিয়ে সবারই বহু বন্ধুবান্ধবী  হয়ে থাকে, তারপর কলেজ ফুরুলে যে–যার ছিটকে পড়ে জীবনযুদ্ধে৷

––তা হলে একটু দুষ্টুই ছিলে বলছ?

––আমাকে  দেখে কী মনে হয়? দুষ্টু?

––এখন তো কিছু বুঝতে পারিনে৷ মুখের অভিব্যক্তি দেখে মনে নিতান্তই ভালো ছেলে৷ ক–দিনই বা আমাদের আলাপ হাসপাতালের এই লনে যখন আলাপ হল, দুজনেরই যৌবন শুরু, কিন্তু দুজনেই জীবনের শেষপ্রান্তে৷ দুষ্টুমিষ্টি বোঝার আর সময় নেই৷

দীপ্তার্ক  মুখ তুলে তাকায় স্নেহার মুখের দিকে৷ স্নেহা তখনও দাঁড়িয়ে আছে তার কাঁধে হাত রেখে, যেন এই স্পর্শটুকু সে চাইছে এই মুহূর্তে, লনে বসে পড়লে তার হাত পৌঁছোবে না হুইলচেয়ারে বসা পরমার্থর কাঁধ পর্যন্ত৷

দীপ্তার্র্ক তার দুর্বল ডান হাতটি তুলে স্পর্শ করতে চায় স্নেহার হাত, ধরতে পারলও, কিন্তু স্নেহা অনুভব করতে পারছে অনেকক্ষণ হুইলচেয়ার চালানোর ফলে দীপ্তার্কর হাত এমনই ক্লান্ত হয়ে পড়েছে যে, তার হাতটা এখন কাঁপছে থরথর করে৷ স্নেহা তার হাতটা ধরল মুঠোয়, হাতের কম্পন থামানোর ব্যর্থ চেষ্টা করল কিছুক্ষণ, তারপর বলল, এই সেদিন তোমার সঙ্গে আলাপ, অথচ মনে হচ্ছে বহুকাল আমরা পরস্পরের চেনাজানা৷   

––হ্যাঁ৷ আমার বাড়ি থেকে প্রায় মাসছয়েক হতে চলল কেউ আর খবর নিতে আসে না৷ তোমাকে তো বলেছি আমার মা নেই, আমার বাবা অনেককাল চেষ্টা করেছেন যদি আমার অসুখটা ভালো হয়, কিন্তু  যখন ডাক্তার বললেন আমার পাদুটো কেটে বাদ দিলেও আর ভালো হব না, এখন কোমর পর্যন্ত ধাওয়া করেছে গ্যাংগ্রিনের জার্ম, কাটতে গেলে সারা শরীরই কাটতে হবে, তারপর থেকে আমার বাবা আশাও ছেড়ে দিয়েছেন, আসাও ছেড়ে দিয়েছেন৷ তারপর বিকেলে দিকে এই লনে আসতে দেয় নার্সরা৷ যেদিন শরীর খারাপ থাকে, আসতে দেয় না৷

স্নেহা চুপ করে থাকে, এক অদ্ভুত বিষণ্ণতা ঘিরে থাকে তাকে, সে কিছু বলার আগেই হঠাৎ তার চোখে পড়ে তাদের ওয়ার্ডের একজন ওয়ার্ডেন দ্রুত পায়ে এগিয়ে আসছে তার দিকে, স্নেহাকে দেখে বলল, আপনি চলে এসেছেন এখানে? ওদিকে ডা. বসু আপনাকে খুঁজছেন৷ বললেন, সেদিন কেমো দেওয়ার সময় আপনার শরীর খারাপ হয়েছিল, তাও আপনি আজ বেরিয়েছেন? শিগগির চলুন ওয়ার্ডে৷

স্নেহাকে ভারী অসহায় দেখায় এ সময়৷ দীপ্তার্র্কর দিকে তাকাতে পারে না, কেন না একটু আগেই সে বলেছে তার শরীর এখন ঠিক আছে, কিন্তু আসলে ঠিক নেই তা জেনে ফেলার পর মুখটা কালো হয়ে গেছে দীপ্তার্কর, বলল, এখনই চলে যেতে হবে?

স্নেহার মুখখানাও শ্রাবণ, ম্লানমুখে বলল, ডাক্তারের বারণ ছিল ওয়ার্ডের বাইরে যাওয়ার৷ তবু শুধু তোমার সঙ্গে দেখা করতেই––, বলে একটু থেমে বলল, ঠিক আছে, আমি আজ যাই, কাল আবার আসব, বলতে বলতে স্নেহা ওয়ার্ডেনের পিছু পিছু ফিরে আসে তার ওয়ার্ডে৷ এসে দেখল ওয়ার্ডেনের কথাই ঠিক, তার জন্য অপেক্ষা করে আছেন ডা. বসু, তাকে দেখেই বললেন, কী হল, তুমি আবার বেরিয়েছিলে লনে?  তোমার হিমোগ্লোবিন এখন কত জানো? মাত্র পাঁচ৷ আজ রাতেই তোমাকে অন্তত দু–বোতল রক্ত দিতে হবে৷ তোমার বাবা হাল ছেড়ে দিয়েছেন, কিন্তু আমরা ডাক্তার , আমরা তো হাল ছেড়ে দিতে পারি না, শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত লড়াই করতে হয় আমাদের৷ তোমার বাবাকে খবর দিয়েছি, বলেছি, যতদিন পারব, চিকিৎসা চালিয়ে যাব৷ আবার পরশু কেমো, তার আগে দু–বোতল রক্ত না দিলে কেমো দেওয়াই যাবে না

স্নেহা পাংশুমুখে হেসে বলে, ডাক্তারবাবু, এই তো গত সপ্তাহে এক বোতল রক্ত দিলেন, না হলে তৃতীয় কেমোটা দিতে পারতেন না বললেন আবার এখন দু–বোতল

––হ্যাঁ৷ আর এখন বাইরে যাওয়া চলবে না কেমোর কোর্সটা শেষ না হওয়া পর্যন্ত একদম বেডরেস্ট

স্নেহা আঁাঁতকে উঠে বলল, একদম যাওয়া চলবে না?

––না৷

ডাক্তারবাবু তাঁর রায় দিয়ে বেরিয়ে যেতেই স্নেহা ক্লান্ত শরীরে শুয়ে পড়ল বেডে৷ দীপ্তার্কর মুখটা ভেসে উঠল তার চোখের সামনে৷ দীপ্তার্ক  নিশ্চয় কাল এসে তাকে খুঁজবে লনে৷ না–পেয়ে মন খারাপ করে একা–একা ঘুরবে হুইলচেয়ারে বসে৷ তারপর পরশুও আসবে, আসবে তার পরের দিনও৷ প্রতিদিন স্নেহাকে না–পেয়ে তাকে গ্রাস করবে প্রবল হতাশায়৷

স্নেহা ঠিক জানে না আারও কতকাল তাকে বদ্ধ থাকতে হবে হাসপাতালের এই বেডে৷ তার আশঙ্কা সত্যি হচ্ছিল ক্রমশ, হয়তো আর দেখা হবে না দীপ্তার্কর সঙ্গে৷

এক প্রবল নৈরাশ্যে ক্রমশ অন্তর্হিত হচ্ছিল স্নেহা৷ মাত্র দু–মাস আগেও তার জীবনে দীপ্তার্ক  ছিল না৷ এখন মনে হচ্ছে কেন তার সঙ্গে আলাপ হল৷ তা হলে তার কষ্ট এভাবে আর একটু বাড়ত না সে তো জানতই তার মৃত্যু অবধারিত, সে নিশ্চিন্তে এগিয়ে যাচ্ছিল সেই পরম মৃত্যুর দিকে , হঠাৎ দীপ্তার্ক  তার জীবনে সামান্য আলোর স্পর্শ দিয়ে তাকে দিয়েছে বেঁচে থাকার আশ্চর্য স্বাদ৷ এখন মনে হচ্ছে আরও কিছুদিন যদি বেঁচে থাকা যেত

সেই মুহূর্তে স্নেহার মনে হল তাদের দুজনের এই দেখা হওয়াটা হয়তো একটা প্রতীক৷ এই পৃথিবীতে ক্ষণিকের জন্য আলাপ হল তাদের৷ অতঃপর তারা দুজনেই যাত্রা করবে এক অন্য লোকে৷ হয়তো সেই অমৃতময় লোকে তাদের দেখা হয়ে যাবে পুনর্বার৷ পৃথিবীর মাটিতে যে–আখ্যান রচিত হতেও গিয়ে হল না, থেমে থাকল কিছু স্বর্গীয় দৃশ্য রচনা করে, সেই আখ্যান হয়তো শুরু হবে সেই নতুন পরিবেশে, নতুন উদ্যান খুঁজে নিয়ে৷ সেখানেও থাকবে এমনই সবুজ ঘাসে ভরা একটি লন যেখানে প্রতিদিন দেখা হবে তাদের৷ দুজনের কথোপকথনে, সাহচর্যে, সঙ্গদানে তার লাভ করবে সেই স্বর্গীয় আনন্দ যা তারা এখানে পেতে–পেতেও পেল না৷ 

Scroll to Top