Thursday, November 27, 2025
বিচক্ষণ শাসক সম্রাট আকবর
সোমনাথ ভট্টাচার্য্য
আকবরের শাসননীতি তাঁর বাস্তব রাজনীতির পরিচয় বহন করে। ভারতবর্ষের মুসলমান শাসকবর্গের মধ্যে আকবর ছিলেন সর্বাপেক্ষা উদার, পরধর্মমত-সহিষ্ণুতা, সমদৃষ্টি, ধর্মনিরপেক্ষতার প্রবর্তক। কেবল মাত্র সমর কুশলীবীর হিসাবেই নয় একজন সুশাসক হিসাবেও শাসক আকবর ভারতবর্ষের রাজনীতিতে স্মরণীয় হয়ে আছেন। ভারতবর্ষে তিনিই প্রথম মুসলিম শাসক যিনি রাজনীতি থেকে ধর্মকে সম্পূর্ণ পৃথক করেন ও রাষ্ট্রকে উলেমাদের প্রভাব থেকে মুক্ত করে ভারতে একটি জাতীয় রাষ্ট্র গঠনে সচেষ্ট হন। জাতি-ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে সকল প্রজাকে সমান অধিকার ও মর্যদায় প্রতিষ্ঠিত করে শাসক আকবর ‘জাতীয় সম্রাট’ পরিণত হয়েছিলেন। শাসক আকবরের শাসন ব্যবস্থায় ‘প্রজাহিতৈষনা ও ধর্মনিরপেক্ষতা’ ছিল মূল স্তম্ভ। প্রচলিত ভারতীয় রীতি-নীতি, গ্রামীন স্বায়ত্ব শাসন ব্যবস্থা কোন কিছুই শাসক আকবর উপেক্ষা করেননি। তাঁর শাসন ব্যবস্থা জনসাধারণের সমর্থনের ওপর নির্ভরশীল ছিল। উদারতা, ধর্মসহিষ্ণুতা ও প্রজাবর্গের সর্বাধিক কল্যান সাধনই ছিল তাঁর শাসন নীতির মূল কাঠামো। ঐতিহাসিক Smith বলেন “From the time of Warren Hastings the newly constituted Anglo-Indian authorities began to grope their way back to the Institutions of Akbar”.
(পরবর্তী-মুঘল সম্রাটরা তো বটেই এমন কি ইংরেজ শাসক দল ও অনেকাংশে তাঁর শাসন
নীতি গ্রহণ করেন।)
ধর্মনিরপেক্ষতার বীজ আকবরের মধ্যে শৈশব থেকেই ছিল। ধর্মীয় উদারতা আকবরের দাদু অর্থাৎ বাবরের চারিত্রিক বৈশিষ্ঠ্য ছিল। কাবুল থেকে অভিযানের প্রাক্কালে বাবর তার পুত্র হুমায়ণকে উপদেশ দিয়েছিলেন “পুত্র, বিভিন্ন ধর্মের মানুষ ভারতে বাস করে। তাই কোনরূপ ধর্মীয় গোঁড়ামির দ্বারা তোমার মন আচ্ছন্ন থাকা উচিত নয়। সমস্ত ধর্মের আদর্শ ও রীতির প্রতি শ্রদ্ধা মিশ্রিত নিরপেক্ষ শাসন প্রয়োগ করা বিধেয়।” বাবর তাঁর আত্ম জীবনীতে লিখেছেন গোহত্যা, ধর্মস্থান ধ্বংস ইত্যাদি কাজ থেকে বিরত থাকা আবশ্যিক। অস্ত্র শক্তি রুক্ষ্যতার পরিবর্তে ভালোবাসা ও বিশ্বস্ততা দ্বারাই ইসলামের প্রসার সম্ভব।”
আকবরের উদার ধর্মনীতির মূলে বিভিন্ন প্রভাব কার্যকর ছিল-
প্রথমত: মাতা হামিদাবানু বেগম এবং কাবুলে অবস্থান কালে সুফী পন্ডিতদের সংস্পর্শে ও গৃহশিক্ষক আ ব্দুল লতিফ এর প্রভাব তাঁর মনে উদারতার বীজ বপন করে। আকবর জন্মেছিলেন অমরকোটের হিন্দু রাজ্য বিরসাল এর গৃহে এবং আপন আত্মীয়ের মত এক মাস পালিত হযে-ছিলেন মহারানীর স্নেহছায়ায়। আকবরের অধিকাংশ বাল্যবন্ধু এবং শিক্ষকরা ছিলেন সহিষ্ণুতা ও উদারতার সমর্থক। তাঁর গৃহ শিক্ষক আব্দুল লতিফ প্রখর যুক্তিবাদী ও পন্ডিত ছিলেন। তাঁর উদারতা এত প্রসারিত হয়েছিল যে, গুনমুগ্ধ ব্যক্তিরা “শিয়া রাজ্যে সুন্নি এবং সুন্নি রাজ্যে শিয়া” বলে অভিহিত করতেন। তার কাছ থেকে আকবর ‘সুলই-কুল’ (Universal brotherhood peace with all) তত্ত্বের শিক্ষা নেয়।
দ্বিতীয়ত: রাজপুত মহিষীদের প্রভাব এবং সেখ মুবারক ও তাঁর দুই পুত্র ফৈজী ও আবুল ফজল-এর সঙ্গে নিবিড় বন্ধুত্ব তাঁকে যথেষ্ট প্রভাবিত করে।
তৃতীয়ত: বিভিন্ন ধর্মমতের প্রচারকদের নিবিড় সাহচর্যে তাঁর চিন্তা ধারায় আমূল পরিবর্তন ঘটে, এছাড়া ষোড়শ শতক হল ধর্ম সংস্কার আন্দোলনের যুগ। ভক্তি আন্দোলন ও সুফী মতবাদ এই যুগে এক ধর্মীয় বিপ্লব ঘটায়। তাই বলা যায় আকবর কেবল মাত্র এই শতাব্দীর সন্তান ছিলেন না শাসক আকবর ছিলেন ভারতীয় রাজনীতিতে ভোরের নতুন সূর্য।
দূরদর্শী শাসক আকবর উপলব্ধি করেন যে, রাজপুতদের যুদ্ধে পরাজিত করা সহজ নয় এবং মুঘল সাম্রাজ্য কে দৃঢ় ভিত্তিতে স্থাপন ও বিস্তৃত করতে গেলে রাজপুতদের মত যোদ্ধা জাতির সাহায্য বিশেষ প্রয়োজন। রাজপুতদের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের ব্যপারে আকবর তাঁর পূর্বসুরিদেরঅপেক্ষা দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়ে ছিলেন। কিন্তু প্রশ্ন হল আকবর রাজপুতদেব বেছে নিয়ে- ছিলেন কেন? বিচক্ষণ শাসক আকবর বুঝতে পেরেছিলেন যে মুঘল সাম্রাজ্যকে দীর্ঘস্থায়ী করতে গেলে রাজপুতদের তাঁর দরকার। রাজপুতগন শৌর্যে, বীর্যে ছিল অদ্বিতীয়। Dr. A.C Banerjee লিখেছেন “দিল্লীর সুলতানদের মতো এদের ধ্বংস করার পরিবর্তে এই মহান ও দূরদর্শী সম্রাট রাজপুতদের মুঘল সাম্রাজ্যের শক্ত ভিতে রূপান্তরিত করেন।” শাসক আকবর রাজপুতদের বন্ধুত্ব কামনা করতেন এবং তাদের বশ্যতা স্বীকারের বিনিময় তিনি তাদের স্বায়ত্ব শাসন ও অন্যান্য সুযোগ সুবিধা দানে প্রস্তুত ছিলেন। রাজপুতদের সাথে মৈত্রীবন্ধন সুদৃঢ় করার ক্ষেত্রে আকবরের প্রধান অস্ত্র ছিল বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন। ১৫৬২ খ্রীঃ আকবর অম্বরের রাজপুত রাজা বিহারী মল্লের আনুগত্য ও মিত্রতা লাভ করেন এবং মৈত্রী বন্ধনকে সুদৃঢ় করার জন্য শাসক আকবর বিহারী মল্লের কন্যা মানবাঈকে বিবাহ করেন। এই বিবাহের দ্বারা ভারতীয় রাজনীতিতে এক নব যুগের সূচনা ঘটে। ড. বেনী প্রসাদ বলেছেন “It symbolised the dawn of a new Era in Indian polities”. বিহারীমল্লের কন্যা মানবাঈ হলেন জাহাঙ্গীরের (সেলিম) মাতা। ১৫৭০ খ্রীঃ শাসক আকবর বিকানীর ও জয়পুরের রাজকন্যাকে বিবাহ করেন এবং ১৫৮৪ খ্রীঃ ভগবানদাসের কন্যার সঙ্গে নিজ পুত্র জাহাঙ্গীরের বিবাহ দেন। এই সব সম্পর্কের পরিনাম হিসাবে বিচক্ষণ শাসক আকবর বিহারীমল্ল, টোডরমল, মানসিংহ প্রমুখ রাজপুত বীরদের পাশে পেয়েছিলেন ও মুঘল সাম্রাজ্যের সামরিক, অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক ভিতকে মজবুত স্তম্ভে রূপান্তরিত করতে পেরেছিলেন। তবে তিনি সকল ক্ষেত্রেই বিনাযুদ্ধে রাজপুতদের বিষয়ে সফল হননি একথা নিঃসন্দেহে বলা যায়। চিতোরের পতনের পর মালব (১৫৬২) খ্রীঃ, রনথম্বোর (১৫৬৯) খ্রীঃ, কালিঞ্জর (১৫৬৯) খ্রীঃ, জয়সলমীর (১৫৭০) খ্রীঃ, মাড়োয়ার (১৫৭০) খ্রীঃ, রাজ্যের বিরুদ্ধে তাঁকে অস্ত্র ধারণ করতে হয়েছিল। প্রভৃতি রাজ্যগুলি একে একে আকবরের বশ্যতা স্বীকার করে। আকবরের ধর্মীয় সহনশীলতা ও সৌহার্দ্যের ফলে পরবর্তীকালে তারা মুঘল সাম্রাজ্যের স্তম্ভে পরিনত হয়। রাজধানী চিতোরের পতন হলেও মেবারের রাজা কিন্তু আকবরের বশ্যতা স্বীকার করেনি। উদয় সিংহের পুত্র রানা প্রতাপ চরম দুঃখ দারিদ্রের মধ্যেও মুঘলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যান এবং মৃত্যুর পূর্বে রানা প্রতাপ চিতোর ব্যতীত মেবারের অধিকাংশই তিনি পুনরুদ্ধার করেন। তাঁর বীর পুত্র অমর সিংহের আমলে ও শাসক আকবর মেবার জয়ের চেষ্টা করেন। কিন্তু তিনি সফল হননি। পার্সিভ্যাল স্পীয়ার বলেছেন “ব্রাহ্মনরা যদি হিন্দুধর্মের মানসিক শক্তি হয় তাহলে রাজপুতরা ছিল তাদের দৈহিক শক্তি।” মূলত এই কারনেই শাসক আকবর রাজপুতদের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনে সচেষ্ট হন।
ভারতের মুসলমান শাসকদের মধ্যে আকবরই সম্ভবত প্রথম ও শেষ ব্যক্তি যিনি ধর্মীয় উদারতা ও সহিষ্ণুতাকে এমন একটা মাত্রা দিয়েছিলেন, যা মধ্য যুগের অন্য কোন শাসক করতে পারেননি। শাসক আকবর বুঝতে পেরেছিলেন যে সমকালিন সামাজিক ও রাজনৈতিক হিন্দুদের আন্তরিক সহযোগিতা যে শক্তিশালী ও স্থায়ী সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য আবশ্যিক। তিনি রাজনীতি থেকে ধর্মকে বিচ্ছিন্ন করে এই অশুভশক্তি ধ্বংস করতে সচেষ্ট হন। বাল্যকাল থেকেই আকবর ফকির ও যোগীদের সংস্পর্শে এসে আকবর মানসিক শান্তি পেতেন। ষোড়শ শতকের ধর্ম আন্দোলন, ধর্মীয় উদারতা এবং প্রেম ও ভক্তিবাদের প্রসার আকবরের জিজ্ঞাসু মনে গভীরভাবে রেখাপাত করেছিল। সুফীসন্ত ও ভক্তিবাসী সাধকদের মানব প্রেম ও সহিষ্ণুতা আকবরকে আকৃষ্ট করেছিল। ১৫৬২ খ্রীঃ থেকে তিনি নিয়মিত ভাবে আজমীরে সুফীসন্ত মৈন উদ্দিন চিন্তীর দরগা পরিদর্শনে যেতেন এবং সুফী গ্রন্থ সমূহ পাঠ করে মনে শান্তি পেতেন। আবুল ফজল উল্লেখ করেছেন “মানকোট অভিযানের সময় (১৫৫৭ খ্রীঃ) আকবরের বয়স যখন মাত্র ১৫ অকস্মাৎ ভাবাবিষ্ট অবস্থায় একবার তিনি সামরিক ছাউনি ছেড়ে দূরে গিয়ে নির্জনে ধ্যানমগ্ন অবস্থায় কিছুটা সময় কাটিয়ে আসতেন।”
শাসক আকবর ১৫৬২ এক নির্দেশ নামা জারি করে তিনি যুদ্ধকালে শত্রুপক্ষের নারী ও শিশুদের ও পর অত্যাচার নিষিদ্ধ করেছেন। ১৫৬৩ খ্রীঃ হিন্দুদের ওপর থেকে ধর্মকর তুলে নেন এবং যমুনায় পুণ্যস্নান অবাধ করেদেন। আবুল ফজলের মতে ঠিক পরের বছরেই এক বৈপ্লবিক সিদ্ধান্ত নিয়ে আকবর দীর্ঘ প্রচলিত “জিজিয়া কর” রহিত করেছেন।
১৫৭৩ খ্রীঃ সুফী পন্ডিত সেখ মুবারক আকবরের সংস্পর্শে আসেন। ১৫৭৫ খ্রীঃ মুবারকের জৈষ্ঠ্য পুত্র তথা কবি দার্শনিক ফৈজী আকবরের সভাসদ হিসেবে যোগ দেন। ঐ বছরের শেষ দিকে আসেন তাঁর কণিষ্ঠ পুত্র আবুল ফজল। আকবরের অভিন্ন হৃদয় বন্ধু আবুল ফজল ছিলেন একদিকে ইতিহাসবিদ, কবি ও অন্যদিকে প্রশাসক। এদের প্রভাবে আকবরের মধ্যে রাষ্ট্রীয় উদারতাবাদের সম্প্রসারণ ঘটে। ভারতবাসীর মধ্যে সার্বজনীন ভালোবাসা ও সংহতি বিকাশের উদ্দেশ্যে তিনি জাতি, ধর্ম বা সংস্কৃতিজাত ভেদাভেদ নির্মূল করতে উদ্যত হন। ইসলাম ধর্মের মৌলিক রহস্য জানার জন্য তিনি আকুল হয়ে ওঠেন। জানতে চান স্রষ্টার সাথে সৃষ্টির সম্পর্ককে। এরজন্য তিনি ফতেপুর সিক্রীতে স্থাপন করলেন “ইবাদত খানা” (Hall of worship) ১৫৭৫ খ্রীঃ এই ধর্মগৃহে প্রথমে কেবল মুসলমান ধর্মজ্ঞানীদের জন্যই উন্মুক্ত ছিল। প্রতি বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় এখানে সমবেত হতেন মুসলমান পন্ডিতগণ। শেখ (ধর্মজ্ঞ), সৈয়দ (খলিফার বংশ-ধর), উলেমা (কোরান-ব্যাখ্যাকার) এবং অভিজাত এই চার শ্রেণীর মুসলিম প্রতিনিধি এখানে ধর্মমত ব্যাখ্যা করতেন ও আকবরের প্রশ্নের জবাব দিতেন। সভার উদ্দেশ্য সম্পর্কে তিনি বলেন “আমার উদ্দেশ্য ছিল সত্য নিরূপণ করা, প্রকৃত ধর্মের মূলসত্য প্রকাশ করা এবং এর সাথে ঈশ্বর শক্তির সম্পর্ক নির্ণয় করা”। (My sole object oh wise mullas! is to ascertain truth, to find out and disclose the principles of genuine religion and to trace it to the divine origin) পরবর্তীতে ১৫৭৮ খ্রীঃ শাসক আকবর “ইবাদত খানার” আলোচনা আবার শুরু করলেন। এবার ইবাদত খানায় তিনি আমন্ত্রন জানান হিন্দু, মুসলিম, খ্রিষ্টান, জৈন, পার্সী, ইহুদী, বৌদ্ধ ধর্মের মানুষদের অর্থাৎ শাসক আকবর তাঁর ইবাদত খানার দরজা সকল ধর্মের মানুষের জন্য খুলে দিলেন। এখানেই শাসক আকবরকে ভারত-বর্ষের অন্য শাসকদের সঙ্গে অভিন্ন করেছে। এখান থেকেই শাসক আকবরের উদারতা, বিচক্ষনতা ও ধর্ম নিরপেক্ষতার পরিচয় পাওয়া যায়। ইবাদতখানা ধর্মগৃহের পরিবর্তে “ধর্ম সংসদের” (Parliament of Religion) পরিনত হয়। “the principles of faiths and creeds be examined, religious, investigated, the proofs and evidences of each be considered and gold and alloy be separated” (Akbarnama).
Dr. K.K. Dutta বলেছেন “His ideal a grand synthesis of all that he considered best in all religious and ideal essentially national” ঐতিহাসিক ডঃ মাখনলাল রায় চৌধুরী আকবরের এই নতুন উপলব্ধির পশ্চাতে দুটি কারণ দেখিয়েছেন তার মধ্যে একটি হল “তিনি উপলব্ধি করেন যে, হিন্দু প্রধান ভারতে সুদৃঢ় সাম্রাজ্য প্রতিষ্টা করতে গেলে সংখ্যাগরিষ্ট হিন্দুদের দূরে সরিয়ে রাখলে চলবে না”। বাদাউনি বলেছেন সম্রাট সভায় উপস্থিত থেকে প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে বিভিন্ন ধর্মের সারমর্ম জানার চেষ্টা করতেন। এই সব ধর্মজ্ঞানীদের মধ্যে উল্লেখ যোগ্য ছিলেন হিন্দু পন্ডিত পুরুষোত্তম ও দেবী, জৈন প্রচারক হরিবিজয় শূরী ও বিজয় সেন শূরী এবং জেসুইট ধর্ম যাজক ফাদার একোয়াভাইভা ও মন সেরেট। আকবর স্বয়ং ব্রাহ্মণদের কাছ থেকে পূজা-পাঠ ও মন্ত্র শেখেন।
‘সিংহাসন বত্তীসী’র অনুবাদক লেখক পুরুষোত্তম ব্রাহ্মন একান্তে তাঁকে পূজা পদ্ধতি বলে দিতেন। আকবর দেবী ব্রাহ্মনের কাছ থেকে অগ্নি, সূর্য তথা অন্যান্য দেবদেবীর পূজা বিধি জানতেন। বাদশাহ মাঝরাত পর্যন্ত সূর্যের মন্ত্র জপ করতেন। বীরবল তো তাঁর সর্বক্ষণের নর্ম সহচর ছিলেন, তিনি হিন্দু ধর্মের খুঁটিনাটি আকবরকে বোঝাতেন। দেবী পন্ডিত আকবরকে বুঝিয়েছিলেন, কেবল ইসলাম, হিন্দু ধর্ম, সুফী মতই নয়, দুনিয়ার সমস্ত ধর্মই সত্য, সকলেই এক ঈশ্বরকে মেনে চলে, সুফী “হুমা ওঃস্থ (সমস্তই তিনি) বলে থাকে, আমরা বলি ‘সর্ব খলু ইদং ব্রমাং’ (এই সমস্তই ব্রহ্ম) মোল্লা বাদায়ুন লিখেছেন তিনি আরবির বিশেষ বিশেষ অক্ষরের হ, অ, স, জ ইত্যাদি উচ্চারণের পার্থক্য পছন্দ করতেন না। অবদুল্লাকে-আকবর আবদুল্লা, অহদীকে আহদী বলতে ভালোবাসতেন। শাসক আকবর ভারতের চৌবন্দী পরতে শুরু করলেন, চোগা ও পাগড়ি খুলে ফেলে গায়ে চড়ালেন জামা, মাথায় দিলেন পাগড়ি, তখতের বদলে সিংহাসনে বসতে লাগলেন। দরবারের সমস্ত সাজসজ্জা বদলে হিন্দু ঢঙে সাজানো হল।
নবর্ষের (নওরাজ) উৎসব আগে থেকেই চলে আসছিল, তাতে হিন্দু রীতি প্রয়োগ করা হল। সেদিন সোনার তুলাদন্ডে বারোটি বস্তু (সোনা, রুপো, রেশম, সুগন্ধি, লোহা, দস্তা, তুঁতে, ঘৃত, দুধ, মধু, চাল ও সপ্ত শস্য) দিয়ে ওজন করাতেন। ব্রাহ্মনকে দিয়ে যজ্ঞ করাতেন। তাঁব জন্মদিনে রূপো, তামা, বস্ত্র, বারো রকমের ফল, মিষ্টান্ন ইত্যাদি দিয়ে নিজেকে ওজন করাতেন। সেইসব বস্তু ব্রাহ্মন ও দরিদ্রদের বন্টন করে দেওয়া হতো। দশহরা উৎসবও শাসক আকবর খুব আড়ম্বর সহকারে পালন করতো, ব্রাহ্মনকে দিয়ে পজো করাতেন, কপালে তিলক কাটতেন, হাতে পরতেন মুক্তো রত্ন খচিত রাখী। আকবর প্রত্যুষে যমুনা তীরের দিকে পূর্বাভিমুখী জানলার কাছে বসতেন এবং সূর্যদয় দর্শন করতেন ও হাতজোড় করে সূর্যের মন্ত্র পাঠ করতেন। যারা প্রত্যুষে স্নান করতে আসত, তারাও জাফরি দিয়ে বাদশাকে দর্শন করতেন ও বাদশাহের নামে জয়ধ্বনি দিতেন।
আকবর হিন্দুদের কুসংস্কারগুলিকেও দূর করতে সচেষ্ট হন, শাসক আকবর সতীদাহ প্রথা নিষিদ্ধ করে দেন। হিন্দুরা ওই প্রথার প্রতি আগ্রহ প্রকাশ করলে আকবর বলেন “ভালো কথা, বিধবা যেমন সতী হয়, তেমনি স্ত্রীর মৃত্যু হলেও পুরুষকেও সহমরণে যেতে হবে।” তা সত্বেও তারা চাপ দিতে থাকলে তিনি বলে ন বিপত্নীক সহমরণে না যাক, তাদের অবশ্যই প্রতিজ্ঞা করতে হবে যে তাবা পুনরায় বিবাহ করবে না”, দুই এক বছর পরে তিনি সতীদাহ প্রথা রদ আইনকে কঠোর ভাবে প্রয়োগ করেছিলেন এবং বলেছিলেন যে নারী সতী হতে চায় না তাকে বলপূর্বক ধরে নিয়ে গিয়ে দাহ করা অপরাধ। মুসলমানদেরও আদেশ দিয়েছিলেন বারো বছর বয়স পর্যন্ত যেন কোন বালকের খৎনা না করা হয়, তারপর সেই বালকের মতামতের উপরেই ব্যাপারটা ছেড়ে দেওয়া হোক, সে খৎনা করতে চায় কিনা।
জৈন ধর্ম আকবরের উপর বিশেষ প্রভাব বিস্তার করেছিল। জৈন মুনি হীরবিজয় শূরী, বিজয় সেন শূরী ও ভানুদ্র উপাধ্যায় আকবরে দরবারে এসেছিলেন। ভানুচন্দ্র তাঁর ‘কাদম্বরীর টীকায়’ জালালুদ্দীন আকবরের নাম সসম্মানে উল্লেখ করেছেন। শাসক আকবর জৈনমুনি হীরাবিজয় শূরীকে ‘জগদবন্ধু’ উপাধি দেন। জৈন পরম্পরায় বলা হয়ে থাকে যে তিনি আবুল ফজল, সেখ মুশরক ইত্যাদি কুড়িজন আমিরসহ আকবরকে জৈন ধর্মে দীক্ষিত করেছিলেন। আকবর কাবুল থেকে প্রত্যাবর্তনের পর আকবর গুজরাটের সিপাহশালারকে লিখেছিলেন তিনি যেন মুনি হীরবিজয়কে দরবারে প্রেরণ করেন। জৈন মুনিদের নিয়ম অনুসারে হীরবিজয় আহমদাবাদ থেকে পায়ে হেঁটে সিক্রীতে এসে পৌঁছান। সিক্রীতে ধুমধামের সঙ্গে তাঁকে স্বাগত জানানো হয়। আবুল ফজলের উপর তাঁর অতিথেয়তার ভার অর্পন করা হয়। ১৫৯৩ খৃস্টাব্দে অপর এক মুনি সিদ্ধিচন্দ্র লাহোরে আকবরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তাকেও উপাধি এবং জৈন তীর্থ সমূহে র তত্ত্বাবধানের ভার দেওয়া হয়। শত্রুঞ্জয় তীর্থযাত্রীদের কর মুকুব করে দেওয়া হয়। শত্রুঞ্জয় পর্বতের (কাঠিয়াওয়াড়ের পালিতানার নিকটস্থ) উপর আদীশ্বর মন্দির নির্মাণ করিয়েছিলেন হীরবিজয় শূরী সেখানে ১৫৯০ খৃস্টাব্দের একটি অবিলেখে শুরি ও আকবরের প্রশংসা করেছেন। জৈন মুনি হীরাবিজয় শূরীর কথায় শাসক আকবর প্রানীবধ, মৎস্য শিকার, মৃগয়া প্রীতি বন্ধ করেন এবং মুনির কথার অনুসারে ১৫৮৩ খ্রীঃ আকবর ফরমান জারি করেন এবং আদেশ দেন কেউ যেন প্রানী বধ না করে, আদেশ লঙ্ঘন কারীদের মৃত্যু দন্ডের বিধান দেন।
আকবর বীরবলকে তাঁর অভিন্নহৃদয় বলে মনে করতেন এবং তাঁকে এত সম্মান করতেন যে তাঁকে ‘রাজা’ উপাধি প্রদান করেও সন্তুষ্ট হননি। এমন অন্তরঙ্গতা যে অন্তপুরেও তাঁকে নিজের কাছে রাখতেন। মোল্লা বদায়ুন বলেছেন ‘বাল্যকাল থেকেই বাদশাহের ব্রাহ্মন, ভাট, এবং হিন্দু সমাজের বিভিন্ন লোকের সঙ্গে বিশেষ ভাব ভালোবাসা ছিল।
রাহুল সাংকৃত্যায়নের লেখা “আকবর” গ্রন্থ থেকে জানা যাবে যে “টোডরমল খুব পূর্জা অর্চনা করতেন। আকবরের সফর সঙ্গী ছিলেন তিনি। একদিন সৈন্যদলের যাত্রার সময় তাড়াহুড়োতে ঠাকুরের সিংহাসন ফেলে আসেন কিংবা কেউ হয়তো সিংহাসনের বটুয়াটিতে মন্ত্রী মহোদয়ের মূল্যবাণ সামগ্রী আছে মনে করে চুরি করে। তিনি পূজা না করে কোনো কাজ করতেন না, মুখে অন্ন তুলতেন না। ফলে আহারাদি ত্যাগ করলেন তিনি। আকবর জানতে পেরে তাঁকে ডেকে বোঝালেন ঠাকুর চুরি হয়েছে, কিন্তু অন্নদাতা ঈশ্বর তো রয়েছেন, তাঁকে তো কেউ চুরি করেনি। স্নান করে তাঁকে স্মরণ করে খাওয়া দাওয়া করো। কোনো ধর্মেই আত্মহত্যা পূণ্যধর্ম নয়।” ইবাদতখানায় ভোরে শাস্ত্রচর্চা চলছে, এমন সময় আকবর ১৫৭৮ খ্রীঃ ডিসেম্বরে গোয়ার পোর্তুগীজ আধিকারীদের নিকটে খ্রিষ্টান ধর্মের পন্ডিত প্রেরণের উদ্দেশ্যে একখানি পত্র পাঠান, সেই পত্রে লেখাছিল “আমি আমার দূত আব্দুল্লা ও দমেনিকো পেরেজকে এই উদ্দেশ্যে পাঠালাম যাতে আপনি দুজন পন্ডিত ব্যক্তিকে আমার কাছে পাঠান তাঁরা যেন ধর্মপুস্তক, বিশেষ করে সমগ্র বাইবেল সঙ্গে করে নিয়ে আসেন। আমি আন্তরিকতার সঙ্গে সে সবের বৈশিষ্ট্য জানতে চাই। আমি আরো জোর দিয়ে বলছি যে তাঁরা তাঁদের বইপত্র নিয়ে আমার রাজদূতের সঙ্গে চলে আসুন। তাঁরা এলে আমি অত্যন্ত আনন্দিত হবো। ১৫৭৯ খ্রীঃ সেপ্টেম্বরে আব্দুলা গোয়া পৌঁছান, গোয়ার পর্তুগীজ ধর্মযাজকদের কাছে একজন যাজককে তাঁর রাজসভায় পাঠাবার অনুরোধ জানান। গোয়ার জেসুইট যাজক সংঘ থেকে আকবরের রাজসভায় দুজন ধর্ম যাজককে পাঠানো হয়েছিল।
তারা হলেন (১) ফাদার রিডোস্কো একোয়াভাইভা (Father Ridolfo Aquaviva)
(২) ফাদার এ্যান্টোনিও মনসেরেট্ (Father Antonio Monserrate)। ফাদার এ্যান্টোনিও মনসেরেট্ আকবরের রাজত্বকাল সম্পর্কে একখানি অতি মূল্যবান ঐতিহাসিক গ্রন্থ ল্যাটিন ভাষায় রচনা করেছিলেন। জেসুইট যাজকরা স্পেনের রাজা ফিলিপের জন্য ছাপানো সুন্দর জিলদ বাঁধাই বাইবেল আকবরকে ভেট দেওয়া হল। শাসক আকবর মাথার পাগড়ি খুলে তিনি বাইবেল সসম্মানে মাথায় রাখেন। জেসুইট ধর্ম যাজকরা নিজেদের সঙ্গে যীশুখৃষ্ট ও কুমারী মরিয়মের চিত্র এনেছিলেন। আকবর তাঁর চিত্রকরদের সে গুলোর প্রতিলিপি অঙ্কন করতে বললেন। শাসক আকবর তাঁর দশ বছরের পুত্র মুরাদকে খৃষ্টান ধর্মও পোর্তুগিজ ভাষা শেখানোর ভার দেন মনসেরেটকে। ১৫৭৯ খ্রীঃ আকবর ফতেপুর সিক্রির মসজিদের ইমামকে সরিয়ে দিয়ে নিজে উপাসনা পরিচালনা করতে শুরু করেন এবং এক মাহজার বা নির্দেশনামা জারী করে বলেন যে তিনি হলেন “ইমাম-ই-আদিল” অর্থাৎ ঐশ্লামিক আইনের চূড়ান্ত ব্যাখ্যাকার এবং সাম্রাজ্যের সর্বপ্রকার জাগতিক ও ধর্মীয় বিষয়ের প্রধান। শাসক আকবর জানান যে ইসলামধর্ম ও কোরানের কোন ব্যাখ্যা নিয়ে মত পার্থক্য দেখা দিলে সম্রাটের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলে বিবেচিত হবে। “মাহজার” ঘোষনা উলেমাদের প্রচন্ড ক্রুদ্ধ করে তোলে। সম্রাটের এই সিদ্ধান্ত তাদের কাছে অস্তিত্বের সংকট হিসেবে বিবেচিত হয়। কোরানের এই আইনবিধির ব্যাখ্যা করে ছিলেন উলেমাগন, যাদের উপাধি ছিল “মুজতাহিদ” আকবর মাহজার দ্বারা নিজেকে “মুজতাহিদ” দের উপর স্থাপন করে উলেমাদের অধিকারে হস্তক্ষেপ করেছেন-এই অভিযোগে গোঁড়াপন্থীদের মুখর করে তোলে। ভিনসেন্ট স্মিথসহ কোন কোন ইউরোপীয় ঐতিহাসিক আকবর কর্তৃক “মাহজার” ঘোষনাকে হসলামীয় রীতির ব্যতিক্রম বলে ব্যাখ্যা করেন। স্মিথের মতে “মাহজার” ছিল ক্যাথলিক ধর্মে রোমান পোপের “অভ্রান্ত কর্তৃক” (Infallib le Decree) কারো মতে এটি ছিল ইংল্যান্ডের “অধিকারের ঘোষণাপত্র” (Declaration of Rights) এর সমতুল্য। কিন্তু অনেক পন্ডিতগন মনে করেন যে উলেমাদের প্রভাব খর্ব করে বিভিন্ন ধর্মের মধ্যে সমন্বয় সাধন করাই ছিল আকবরের উদ্দেশ্য। ড. ত্রিপাঠী মনে করেন “সমসাময়িক পরিস্থিতিতে এই ধরনের একটা কর্তৃত্ব সম্রাটের অস্তিত্বের জন্য প্রয়োজন ছিল। ঐস্লামিক রাষ্ট্রতত্ত্ব অনুযায়ী সমস্ত মুসলিম রাষ্ট্রই ধর্মাশ্রয়ী এবং এই রাষ্ট্রব্যবস্থার ধর্মগুরু উলেমা সম্প্রদায় (মৌলা) বিশেষ ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব ভোগ করতেন। রাষ্ট্রীয় প্রশাসনে উলেমাদের ইচ্ছা-অনিচ্ছা প্রতিফলিত হত। কোরান, হাদিস ইত্যাদি আইন গ্রন্থের ব্যাখাকারী হিসাবে উলেমাদের হাতে এই ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয়েছিল। কিন্তু উলেমাগন সেই মহান ধর্মীয় কর্তব্য বিস্মৃত হয়ে ক্ষমতার রাজনীতিতে অবগাহন করেন ফলে, অন্তত মুঘল-ভারতে উলেমাদের ভূমিকা সংহতির পরিবর্তে অন্তর্দ্বন্দু জন্ম দেয়। শিয়া, সুন্নী প্রভৃতি মুসলমানদেব বিভিন্ন গোষ্ঠীর অন্তদ্বন্দ্ব এক ধর্মমতের বিরুদ্ধে অন্য ধর্মমতের জেহাদ ইত্যাদি ঘটনা সাম্রাজ্যের অভ্যন্তরীন নিরাপত্তা এবং ঐক্যবোধকে আঘাত করেছিল। এমতাবস্থায় সম্রাট আকবর নিজ হাতে ধর্মীয় কতৃত্ব গ্রহন করে ধর্মকেন্দ্রিক উত্তেজনা প্রশমনের সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছিলেন। কোন কোন পন্ডিত “মাহজার” কে উলেমাতন্ত্রের “শশ্মান সঙ্গীত” বলে মনে করেন। অধ্যাপক এস.রায় বলেছেন-“It may Akbar, who was temporal head of the state, the supreme head of church or properly the Islamic faith in India, as well.”
আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে মুসলিম রাষ্ট্রগুলির ক্ষমতার দ্বন্দ্বের প্রেক্ষাপটেও আকবরের “মাহজার” জারির গুরুত্ব লক্ষনীয়। সেই সময় ঐস্মালিক রাষ্ট্রসংঘের কর্তৃত্ব দখলের প্রশ্নে পারস্যের শাহ ও তুরস্কের সুলতানের মধ্যে প্রতিযোগিতা চলছিল। পারস্যের শাহ নিজেকে “সিয়া” সম্প্রদায়ভূক্ত মুসলমানদের নেতা বলে দাবি করেছিলেন। অন্যদিকে তুর্কী সুলতান ছিলেন সুন্নী সম্প্রদায়ভুক্ত এবং তিনি নিজেকে “খলিফা” বলে মুসলিম সমাজের নেতৃত্বের দাবিতে অটল ছিলেন। উভয় পক্ষই ভারতের মুঘল শাসকদের স্বপক্ষে পেতে আগ্রহী ছিলেন। এক্ষেত্রে কোন বিশেষ পক্ষ অবলম্বন করলে অন্যপক্ষের বিরূপতা ভারতীয় সাম্রাজ্যের ও অধিবাসীদের শান্তি বিঘ্নিত করতে পারত। তাই শাসক আকবর উভয়পক্ষ থেকে দূরে থেকে এক স্বতন্ত্র ও স্বাধীন ধর্মদর্শন অনুসরণের সিদ্ধান্ত নেন। এই দুই বিদেশী কর্তৃত্বের অবসান ঘটানোর ক্ষেত্রে মাহজার এই গুরুত্ব অসীম। ডঃ মাখল লাল রায়চৌধুরী লিখেছেন “মাহজার” এর ঘোষনা সম্রাটের রাজনৈতিক প্রজ্ঞার শ্রেষ্ঠ নিদর্শন হিসেবে চিরদিন অভিনন্দিত হবে।
আকবরের ধর্মভাবনার চূড়ান্ত পরিণতি ছিল ‘দীন-ই-ইলাহী’ (Din-I-Illahi) ধর্মমত। শাসক আকবর সকল ধর্মের সারবস্তু নিয়ে প্রচলন করেন দীন-ইলাহী ধর্মমত ১৫৮২ খ্রীঃ, বাল্যকাল থেকে ধর্ম সম্পর্কে তাঁর আকুল জিজ্ঞাসা, সৃষ্টি ও স্রষ্টার সম্পর্ক নির্ধারনের আন্তরিক প্রয়াস হিন্দু, জৈন, খ্রীষ্টান, পারসিক, মুসলিম ইত্যাদি ধর্মবিদদের সান্নিধ্য ও আলোচনা তাঁর মনে ধর্মের স্বরূপ সম্পর্কে নতুন ধারনার উন্মেষ ঘটিয়েছিল। বিভিন্ন ধর্মের সারমর্ম অনুধাবন করার ফলে তাঁর মনে এক নতুন ও চিরন্তন সত্যের উদয় হয়েছিল। শাসক আকবর এই বিশ্বাসে স্থির হয়েছিলেন যে বিভিন্ন ধর্মের তত্ত্বও আচরণ প্রভেদ থাকলেও, সকল ধর্মের লক্ষ্য এক। একজন ন্যায় পরায়ণ শাসক হিসেবে তিনি রাষ্ট্র ও তাঁর প্রজাবর্গের মঙ্গল সাধনকে নিজ কর্তব্য বলেই বিবেচনা করতেন। আধ্যাত্মিক চেতনা থেকে তিনি ধর্মকে পার্থিব জগতের সর্বাঙ্গীন বিকাশের মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করেন। তাঁর রাজাদর্পের ভিত্তি ছিল জাতীয়তাবোধ ও সৌভ্রাতৃত্ব। এজন্য বাস্তববাদী ও দূরদৃষ্টি শাসক কোন ধর্মকে অস্বীকার না করেও বিভিন্ন ধর্ম সম্প্রদায়ের অন্তর্নিহিত বিভেদ ও বিবোধ দূর করতে চেষ্টা করেন। ক্যাথলিক পাদরি বার্তালি “দীন-ই-ইলাহী” প্রবর্তনে সম্রাটের বক্তব্য উল্লেখ করে লিখেছেন “প্রজাদের মধ্যে বিভেদ ও বিবাদ ক্ষতিকর। তাদের এমনভাবে একত্রিত করা উচিত যাতে প্রত্যেকে নিজের স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখে পরস্পরের মধ্যে মিশে যেতে পারে। যে কোন ধর্মের সারবস্তু যেন না হারায়। এতে ঈশ্বর সন্তুষ্ট হন, সমাজে শান্তি আসে এবং সাম্রাজ্যে নিরাপত্তা আসে।” হিন্দু দার্শনিক দেবী ও পুরুষোত্তম, জৈন পন্ডিত ভানুচন্দ্র ও হরিবিজয়। জেসুইট পাদ্রী রিভোলফো এ্যকোয়াভহিভা ও এ্যান্টনী মনসেরেট, শিখ গুরু অমর দাস ও রামদাস প্রমুখের সাথে নিয়মিত ধর্মালোচনার ফলে তত্ত্ব জিজ্ঞাসু সম্রাটের এই ধারনা হয়েছিল যে কোন ধর্মই একক ভাবে সমস্ত সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্প্রিতি তৈরী করে শান্তির বাতাবরণ গড়ে তোলার পক্ষে যথেষ্ট নয়। এজন্য তিনি সমস্ত ধর্মের ভালো দিক গুলির সমন্বয়ে একটি নতুন ধর্মাদর্শ প্রচারের আবশ্যিকতা অনুভব করেন এবং ঘোষণা করেন “দীন-ই-ইলাহী” নামক সমন্বয়বাদী আদর্শের। ভননোয়ের এর মতে “দীন-ই-ইলাহীকে একেশ্বরবাদ” না বলে ‘সর্বেশ্বরবাদ’ বলাই যুক্তিসংগত। কারণ এখানে কোন বিশেষ ঈশ্বরের কথা বলা হয়নি। বরং এই মতাদর্শের সমস্ত ধর্মের মহান তত্ত্বগুলিকে একত্রিত করার চেষ্টা করা হয়েছে। বাদাউনি আকবরের এই ধর্ম বিশ্বাসকে “তৌহিদ-ই-ইলাহী” বলে অভিহিত করেছেন। আকবর কখনোই নিজেকে প্রচারক বা প্রত্যাদৃষ্ট পুরুষ বলে দাবি করেননি। সম্রাটের অতিকাছের হিন্দুদের মধ্যে একমাত্র বীরবল “দীন-ই-ইলাহী” সম্প্রদায়ভুক্ত হয়ে-ছিলেন। ভগবান দাস মানসিংহের মত সম্রাটের অতিকাছের মানুষজনও “দীন-ই-ইলাহী” সম্প্রদায়ভুক্ত হননি। এজন্য তারা কখন শাসক শ্রেণির চাপের স্বীকার হননি। কারণ এটি ছিল মূলত এক “নৈতিক জীবন বাদ”। ঈশ্বরী প্রসাদ এর মতে “It was an electic Pantheism, Containing the good points of all religions a combination of my-sticism, philosophy and nature worship. Its basis was rational it up held to dogma recognized no Gods or prophets”.
“দীন-ই-ইলাহী” (দিব্য ধর্ম) বিভিন্ন ধর্মের মধ্যে বিভেদ বিদ্বেষ সংঘর্ষ দূর করার জন্যই প্রবর্তিত হয়েছিল। এটি ছিল একটি রাষ্ট্রীয় ধর্মের নামান্তর এর অন্তরে ছিল রাজনৈতিক ঐক্য স্থাপন, সাম্প্রদায়িকতা দূরীকরণ, মানুষের মধ্যে সহিষ্ণুতার প্রবৃত্তি জাগরিত করার উদ্দেশ্যে শাসক আকবরের ধর্মমত ছিল তাঁর রাজনৈতিক দূরদর্শিতার বহিঃপ্রকাশ। পন্ডিতগন মনে করেন “দীন-ই-ইলাহী” ধর্মমত প্রচলন করে শাসক আকবর এই বার্তা দেশবাসীকে দিতে চেয়েছিলেন যে তার চোখে সকল ধর্মই সমান। কারণ তিনি সকল ধর্মের সারবস্তু নিয়ে “দীন-ই-ইলাহী” ধর্মমত প্রচলন করেন। মোট ১২জন ব্যক্তি “দীন-ই-ইলাহী” ধর্মমত গ্রহণ করেছিলেন। “দীন-ই-ইলাহী” সম্প্রদায়ভুক্ত ব্যক্তি পরস্পরকে সম্বোধন করার সময় “আল্লাহ আকবর” এবং “জাল্লে জালাই-ইহু” কথা ব্যবহার করতেন। সামাজিক কর্তব্য হিসেবে ‘দীন-ই-ইলাহী’ সম্প্রদায়ের ব্যক্তিকে কিছু বিধি নিষেধ পালন করতে হত। যেমন বৃদ্ধা বা শিশুকন্যাকে বিবাহ না করা, কসাই, পশু শিকার, মৎস শিকারী প্রমুখের সাথে খাদ্য গ্রহণ না করা ইত্যাদি।
শাসক আকবর শাসন পরিচালনায় যেমন ধর্মনিরপেক্ষতার সাক্ষ্য রেখেছেন তেমনি কাব্য সাহিত্য, দর্শন সংগীত, চিত্রকলায়তেও ধর্মনিরপেক্ষতার ও সর্বধর্মসমন্বয়ের পরিচয় রেখেছেন।
আকবরের রাজত্বকালকে মুঘল সাহিত্যের সুবর্ণ যুগ বলা হয়। আকবরের রাজত্বকালে যেসব সাহিত্য কর্ম হয়েছিল তাদের ইতিহাসে মূল্য অপরিসীম। আকবরের যুগে রচিত অধিকাংশ গ্রন্থকে ইতিহাস সাহিত্য হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া যায়। আকবরনামা, ‘আইন-ই-আকবরী’, তারিখ ই আকবর শাহী, কিন্তু দূরদৃষ্টি সম্পন্ন আকবর তাঁর সাহিত্য, সঙ্গীত, চিত্রকলা বিজ্ঞানের ধর্ম নিরপেক্ষতার প্রমাণ দিয়েছেন।
আকবরের আমলে বহুকালজয়ী সংস্কৃত কাব্যসাহিত্য ফারসী ভাষায় অনূদিত হয়েছে। শাসক আকবরের চেষ্টায় মহাকাব্য মহাভারতের বিভিন্ন পর্ব বিভিন্ন মুসলমান পন্ডিত দ্বারা অনুবাদ করে “রজমনামা” নামে সংকলিত হয়। বাদাউনি রামায়নের ফারসী অনুবাদ করেন। অর্থবেদ ‘হাজি ইব্রাহিম শিরহিন্দী’ কর্তৃক অনুবাদ হয়। ভাগবত পুরানের ফারসী অনুবাদ করেন টোডরমল। বেদের বিবরনের ওপর ভিত্তি করে অমরনাথ ফারসী ভাষায় বিশ্ব ইতিহাস রচনা করেন। হিন্দু গনিতশাস্ত্র “লীলাবতীর” অনুবাদ করেন ফৈজী। সেই সময় গ্রীক ও আরবীয় কিছু গ্রন্থ ফারসী ভাষায় অনুবাদিত হয়। শাহজাদা দারাশুকো ছিলেন পন্ডিত এবং উদারমনা। তিনি কয়েকজন ব্রাহ্মন পন্ডিতদের সহায়তায় অর্থবেদ, উপনিষদ ও গীতার ফারসী ভাষায় অনুবাদ করা হয়। আকবরের আমলে ফারসী অনুবাদকের কাজে বহু ব্রাহ্মন পন্ডিত সাহায্য করেন। এছাড়া যশোবন্ত-রাই-মুন্সী, ভগবানদাস, সুজন রাই, ঈশ্বর দাস প্রমুখ অনেকেই কাব্য, সাহিত্য ও ইতিহাস মূলক গ্রন্থ রচনায় পারদর্শিতা দেখান।
হিন্দু, ইরানী, তুরানী, কাশ্মারী প্রভৃতি বিভিন্ন জাতির ৩৬জন সঙ্গীতজ্ঞ আকবরেব দরবারে উপস্থিত ছিলেন। শাসক আকবর সুন্দর নাকড়া বাজাতেন। আকবরের দরবারে শ্রেষ্ট সঙ্গীতজ্ঞ ছিলেন তানসেন যার পূর্ববর্তী নাম ছিল রামতনু পান্ডে। আবুল ফজলের মতে সঙ্গীতকলা সম্পর্কে আকবরের যে ব্যুৎপত্তি অর্জন করে-ছিলেন তা অনেক দক্ষ সঙ্গীত কারের মধ্যেও ছিল না। হিন্দু রাগ সঙ্গীত সম্পর্কে আকবর ‘লালা বলবন্ত’ এর কাছে শিক্ষা গ্রহণ করেন। দক্ষ শিল্পীদের উৎসাহিত করার জন্য দৃষ্টান্ত হিসাবে আব্দুর রহিম খান-খানান কর্তৃক জনৈক সঙ্গীতজ্ঞ রামদাসকে একলক্ষ টাকা এবং সম্রাট আকবর কর্তৃক প্রখ্যাত সঙ্গীতবিদ তানসেনকে ‘দু লক্ষ’ টাকা পুরস্কার প্রদান করেন।
আকবরের রাজত্বকালেই মুঘল চিত্রকলার যাত্রা শুরু হয়েছিল। সাহিত্যের মতই মমতা ও একাগ্রতা দিয়ে মহান শাসক আকবর চিত্রকলাতেও ধর্মনিরপেক্ষতার স্বাক্ষর রেখেছেন।
আকবরের আমলে প্রথম ১৭জন চিত্র শিল্পীদের মধ্যে ১৩জন ছিলেন হিন্দু। আকববের সময়ে হিন্দু চিত্রকরদের প্রাধান্য ছিল লক্ষনীয়। হিন্দু চিত্র শিল্পীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন দশবন্ত, বসাওন, রেশজ, মুকুন্দ, সাম্বালা, তারা ভগবান, মধুলাল প্রভৃতি ছিলেন অবিস্মরণীয়। বসাওয়ন ছিলেন প্রতিকৃতি অঙ্কনে সিদ্ধহস্ত। দশবন্ত ছিলেন জাতিতে কাহার (পালকি বাহক) কিন্তু অঙ্কন প্রতিভা আকবরকে মুগ্ধ করেছিল। ‘রাজমনামা’ গ্রন্থে অলংকারনে দশবন্তের প্রতিভার স্বাক্ষর পাওয়া যায়।
ভারতের শাসন ক্ষমতায় টিকে থাকতে গেলে যে, ধর্মনিরপেক্ষতা মূল মন্ত্র বিচক্ষণ শাসক আকবর তা বুঝতে দেরি করেননি। তিনি তাঁর শাসন পরিচালনার প্রতিটি পদক্ষেপে বাড়ে বাড়ে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন – তা বন্ধুত্বের স্তরে, রাজনৈতিক স্তরে, অর্থনৈতিক স্তরে, বৈবাহিক স্তরে, ধর্মীয় স্তরে এবং সাহিত্য ও শিল্প কলার ক্ষেত্রে। শাসক আকবর চেয়েছিলেন হিন্দু, মুসলমান, জৈন, পারসি, খ্রীস্টান উভয় পক্ষ মিলেমিশে এক জাতি হয়ে উঠুক। একটি ভারতীয় জাতিতে পরিণত হোক। বর্তমানে আকবরের পথ আজ অনেকদূর অবধিই আমাদের পথ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আকবর ষোড়শ শতাব্দীর নয়, বরং একবিংশ শতাব্দীর ভারত-বর্ষের রাজনীতির পথ প্রদর্শক, ভারতবর্ষের রাজনীতির ইতিহাসে গান্ধীজীও আকবরের নাম একই সঙ্গে উচ্চারিত হওয়া উচিত। কারণ দুজনই ভারতবর্ষকে একটি জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে একটি ঐক্যের বন্ধনে বাধতে চেয়েছিলেন। জেসুইট পাদরিরা এক জায়গায় লিখেছেন ‘আকবর সম্পর্কে জনগনের ধারণা বিভিন্ন রকম, কেউ মনে করেন তিনি খ্রীষ্টান, কেউ মনে করেন তিনি ধর্মশূণ্য, কেউ মনে করেন তিনি মুসলমান। প্রকৃত বুদ্ধিমানরা মনে করেন তিনি খ্রীষ্টানও নয়, ধর্ম শূণ্যও নয়, মুসলমানও নয় তিনি আসলে সত্যান্বেষী। সম্ভবত আকবরের ধর্মদর্শন সম্পর্কে এটিই সঠিক মূল্যায়ন।
গ্রন্থঋণ
১। আকবর-রাহুল সাংকৃত্যায়ন
২। মুঘলবাজ থেকে কোম্পানীরাজ অধ্যাপক গোপালকৃষ্ণ পাহাড়ী
