Published on – Sunday, November 23, 2025
ওরা অকারণে চঞ্চল
শ্রীপর্ণা বন্দ্যোপাধ্যায়
“ছোটা বচ্চা সমঝকে হামসে না টকরানা রে –”। গানটা ‘মাসুম’ নমের এক হিন্দী চলচ্চিত্রের। বলা বাহুল্য মাসুম বা সরল বলতে বাচ্চাদেরই বোঝানো হয় পারতপক্ষে। তবে তাদের সারল্য যে অনেক তাবৎ তাবৎ ঘুঘুকে গোল খাইয়ে দিতে পারে ছবিটার বিষয়বস্তু সম্ভবত তাই ছিল। আর ছবি কেন বাস্তবেও বাচ্চাদের সপ্রতিভতার সামনে আমরা অনেকেই ক্যাবলা বলে যাই। আপনি বলুন তো আপনার স্মার্টফোন, কি ট্যাব কে বেশি ভালো কব্জা করেছে – আপনি না আপনার অনুর্ধ্ব পাঁচ শিশুটি?
মা বাইরে। বসার ঘরে দু ছেলে টিভি দেখছে। তাদের বাবা অফিস থেকে ঘরে ফিরে বড় ছেলেকে এক গ্লাস জল চাইল। বড় ছেলে বাবাকে গ্রাহ্যই করল না, নিজের মনে টিভি দেখে যেতে লাগল। ভদ্রলোক বার কয়েক বলার পর রেগে যেতে ছোট ছেলে বলল, “বাবা, দাদাটা ভীষণ অবাধ্য আর কুঁড়ে। ওকে বলে কোনও লাভ নেই। কী আর করবে? তুমি ভেতরে গিয়ে জল খেয়ে নাও, আর আসার সময় আমার জন্যও এক গ্লাস নিয়ে এসো ঠাণ্ডা জল মিশিয়ে”।
সেই ছোট ছেলেটা, যার নাম ধরা যাক বিচ্ছু, তাকে পরে মা-বাবা এক বোর্ডিং স্কুলে দিয়ে দেয়। মিশনারি বোর্ডিং স্কুলটির চ্যাপেলে এক জায়গায় টুকরি ভরে আপেল রাখা আছে। পাশে একটা নোটিস বোর্ডে লেখা, “একটা করে নেবে, ভগবান দেখছেন”। একটু এগিয়ে আর একটি টুকরিতে চকোলেট ক্যান্ডির স্তূপ। সেখানে পাশের বোর্ডটা ফাঁকা। বিচ্ছু চক দিয়ে লিখল, “যতগুলো খুশি নাও। ভগবান আপেল পাহারায় ব্যস্ত”।
বিজ্ঞান ক্লাসে শিক্ষক বোঝাচ্ছেন আবিষ্কার আর উদ্ভাবনের মধ্যে ফারাক। কী বুঝেছে ছাত্রদেরকে একটা উদাহরণ দিয়ে বোঝাতে বললেন। বিচ্ছুর বন্ধু বলল, “স্যর, বাবা প্রথমে মাকে আবিষ্কার করে। তারপর দুজনে মিলে আমায় উদ্ভাবন করে”। বিচ্ছুর নাম বিচ্ছু হলে এর তার বন্ধুর নাম কী হওয়া উচিৎ আমার জানা নেই। তবে বর্তমানে টেলিভিশন চ্যনেলগুলোর কমেডি শো, হোয়াট্স্ অ্যাপ, ফেসবুক জুড়ে দাম্পত্যের দুষ্টুমিষ্টি চাপান উতোরের পরেই এই বাচ্চু, বিচ্ছু, পাপ্পু, বিট্টুদের দৌরাত্ম।
ছেলেখেলা বলতে নেহাৎ সহজ হেলেফেলার কাজ বুঝি, কিন্তু ছেলেমানুষ যে খুব সহজ অন্তত হেলাফেলা করার মতো প্রাণী নয় তা নিয়ে বড়রা বিলক্ষণ জানেন। এই প্রথাগত ‘ছেলে’ শব্দটির মধ্যে বলা বাহুল্য বাচ্চা ‘মেয়ে’ সম্প্রদায়ও অন্তর্ভূক্ত। আর মেয়েরা দুষ্টুমিতে বিশেষ করে অন্যের অনিষ্ট করার প্রতিযোগিতায় খানিক পিছিয়ে থাকলেও পাকামিতে পশ্চাদ্পদ একথা তাদের চরম নিন্দুকেও বলবে না।
আমরা তৃতীয় বার সিকিম গিয়েছিলাম মোট চারটি পরিবারের এগারোজন সদস্য মিলে। আমরা তিনজন ছাড়াও আমার মা বাবা, আমার জীবনসঙ্গীর অফিসের এক সহকর্মী দম্পতি ও তাদের কন্যা এবং কন্যার মাসি-মেসো-মাসতুতো ভাই। গ্যাংটক থেকে য়ুমথাং দেখার জন্য লাচুং থাকার সময় দেখি ওর অফিসের সেনগুপ্তদা একটা ছোট্ট বোতল বার করেছেন। তাই নিয়ে সেনগুপ্তদি বেজায় চটে রাগারাগি করছেন। দাদার শরীরে নানা আধিব্যধি, তার মধ্যে এই উপদ্রব কেন? দিদিকে বোঝানোই যাচ্ছে না ৩৩০ মিলিলিটার নয়-দশ ভাগ হলে পরে তা শীত, মেজাজ, যকৃত কাউকেই বিশেষ কব্জা করতে পারবে না। আমার সদ্য ক্লাস ওয়ানে অ্যাডমিশন নেওয়া পাঁচ পূর্ণ করা কন্যা তার বাবাকে শাসনের ভঙ্গীতে বলল, “বাবা, তুমি কিন্তু খাবে না”।
আমার বেশ মজা লাগল। ওকে প্রশ্ন করলাম, “কেন রে? বাবাকে খেতে মানা করছিস কেন? ওটা কী?” মাকে নিয়ে তার ভাবনা নেই, সে জানে মা নরম পানীয়ের ভক্ত। বাবাকেও কড়া পানীয় পান করতে দেখেনি, তবু অনুমান করেছে পরিস্থিতির দাবিতে সাড়া দিলে বাবাই দিতে পারে।
“কমন নেমটা জানি না। প্রপার নেমটা দেখেছি – রয়াল চ্যালেঞ্জ।”
কৃতিত্বটা কাকে দেব, আইসিএসসি বোর্ডের পাঠ্যসুচী না একটি পাঁচ বছরের বালিকার অন্তর্দৃষ্টি? তবে মদের বোতলও যে ব্যকারণ শিক্ষায় কাজে লাগতে পারে তা ঐ শিশুর কাছে শিখলাম।
