Sunday, November 23, 2025
বঞ্চিত ও লাঞ্ছিত নজরুল
ড. কালী চরণ দাস ও প্রবীর আচার্য
গ্রাম বাংলার এক দরিদ্র এবং অবহেলিত পরিবারে তাঁর জন্ম হলেও বিশাল এক সহজাত প্রতিভা নিয়ে জন্মেছিলেন নজরুল। জন্মের পর থেকেই তিনি চরম-ভাবে বঞ্চিত এবং লাঞ্ছিত হতে থাকেন। কেবল মাত্র আপন পুরুষকার এবং জন্মগত প্রতিভাকে সম্বল করে তিনি উঠে এসেছিলেন বাঙালির হৃদয়ের কবি হিসেবে। এ-এক অতি আশ্চর্য ব্যাপার। তাঁর অ-সাধারণ জীবনী-শক্তির পিছনেই কিন্তু রয়েছে অন্ধকার; দারিদ্র্য, বঞ্চনা এবং নির্যাতন। আর তার ফলেই তাঁকে সারাজীবন ভোগ করতে হয়েছে অশেষ যন্ত্রণা।
এ-প্রবন্ধে তাঁর জীবন সংগ্রামের ইতিহাসের সঙ্গে যে-মানসিক এবং দৈহিক আঘাত তাঁকে সারাজীবন বিধ্বস্ত করে তুলেছিল তার একটা সংক্ষিপ্ত বিবরণ তুলে ধরার চেষ্টা করা হবে।
দুঃস্থ গ্রাম্য মুসলিম পরিবারে জন্ম-হওয়ার সূত্রে দুর্ভাগ্য তাঁকে শৈশব থেকেই তাড়া করে ফেরে। ১৯০৮ খ্রিস্টাব্দের ৮ এপ্রিল মাত্র ন’বছর বয়সে তাঁর বাবা মারা যান। নিজের দু’মুঠো পেটের ভাতের জন্য তাঁকে রেলের এক গার্ডের অধীনে খানসামাগিরি করতে দেখা যায়। তাঁর কাজ ছিল, মদ্যপ গার্ড-সাহেবের জন্য আসানসোল থেকে পানীয় কিনে আনা। কখনও রুটির দোকানে মাত্র এক টাকা বেতনেই তিনি চাকরি করতেন আর রাত কাটাতেন পুলিশ সাব-ইনস্পেক্টর কাজি রফিজুল্লাহের বাসায়, একতলায় সিঁড়ির নীচে। অনেকে বলেন- রুটির দোকানে চাকরি ছেড়ে ওই পুলিশ সাহেবের গৃহ-ভৃত্যের কাজও তিনি কিছুদিন করেছিলেন মাসিক পাঁচ টাকা বেতনে। পুলিশ-সাহেব তাঁকে স্কুলে ভর্তি করে দেবেন বলে কথা দিয়েছিলেন। প্রলোভন সেটুকুই।১ বলা বাহুল্য ছোটো বেলা থেকেই নজরুল ছিলেন অত্যন্ত স্পর্শ-কাতর। সময় অ-সময়ে গৃহ-কর্তার দু-এক-ঘা চড়-চাপড়ও যে তাঁকে সহ্য করতে হয়নি, এমন কথা নয়। তিনি শুধু চোখের জল ফেলেছেন কিন্তু প্রতিবাদ করার মতো ক্ষমতা তাঁর তখন ছিল না। তাঁকে গড়ে-তোলার মতো কোনও অভিভাবক ছিল না, মা ছিলেন অ-সহায়া এক বিধবা, কাজেই কবি নীরবে হজম করেছেন ওই যন্ত্রণা আর মানসিক নির্যাতন। তিনি তখন থেকেই ক্রমশ অন্তর্মুখী হয়ে ওঠেন। ভবিষ্য-জীবনে যন্ত্রণার কথা তিনি মুখ ফুটে কখনও বলতেন না, সঙ্গী ছিল দিলখোলা এক সরল হাসি। ওই হাসির অন্তরালে তিনি যেন লুকিয়ে রাখতেন তাঁর যত গভীর-ব্যথা।
ছাত্র হিসেবে মাথরুণ, পূর্ব বাংলার দরিরামপুর কিংবা শিয়ারশোল ঘুরে, ম্যাট্রিকের টেস্টের সময় তিনি চলে যান ফৌজে চাকরি নিয়ে। সেও এক মানসিক যন্ত্রণার শিকার হয়ে। কেউ বলেন– সে-সময় স্কুলের অবস্থা মোটেই ভালো ছিল না, ছাত্রেরা পরবর্তী জীবনে বেকারত্বের ভয় পেত। অতএব যা-হোক একটা চাকরি পেলেই তারা স্কুল ছেড়ে চলে যেত।২ নজরুলের ছিল আরও এক সমস্যা, তিনি জানতেন স্কুলে পড়াকালীন কাশিমবাজারের রাজা মণীন্দ্রচন্দ্র নন্দী প্রদত্ত রাজ-বৃত্তির মেয়াদ স্কুল ছাড়লেই শেষ হয়ে যাবে, অতএব চাকরি-নেওয়া ছাড়া তাঁর তখন কোনও উপায় থাকবে না। কেউ বলেন, তিনি এক গ্রাম্য মেয়ের প্রেমে পড়েন এবং প্রেমে আঘাত পেয়েই অভিমানে দেশ-ত্যাগ করেন। অনেকে আবার নতুন কথা শোনান এবং সেটিই যে তাঁর মনোব্যথা এবং গ্রাম বা পরিবার ত্যাগের কারণ ছিল না, কে তা বলবে। পরিবারে তাঁর দুঃখে চোখ-মোছার মতো কোনও লোক ছিল না। বিধবা মা জাহেদা খাতুন সম্ভবত নিরাপত্তাহীনতা ও দারিদ্র্যের জ্বালায় বিবাহ করেন তাঁর মৃত স্বামীর এক নিকট-জ্ঞাতিকে। নজরুলের কাছে এর চেয়ে বেশি মানসিক নির্যাতনের আর কী কারণ থাকতে পারে। তাই বুঝি তিনি পরবর্তী জীবনে স্ব-গ্রাম-মুখী আর হননি, দু’-একটি ব্যতিক্রমী মূহূর্ত ছাড়া।৩
করাচির ফৌজি প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে থাকা-কালীন তিনি নানা দেশের নানা খবর রাখতেন এবং বন্ধু-বান্ধবদের মানসিক বিকাশের জন্য চেষ্টা করে যেতেন। ওই ক্যাম্পে শারীরিক কষ্ট থাকলেও দিলদরিয়া স্বভাব-গুণে তিনি সেখানে বেশ মেজাজেই কাটাতেন। পেটের ভাতের জন্য কারও বাড়িতে চাকর-গিরি করার চেয়ে সে-কাজ তাঁর কাছে অনেক ভালো ছিল। তা-ছাড়া সেখানে তিনি সাহিত্য নিয়েও সময় কাটাবার সুযোগ পেতেন, লেখা-জোখার অভ্যেসও ছিল। কিন্তু সে-সুখ বেশি দিন আর স্থায়ী হয় না। ১৯২০ খ্রিস্টাব্দের মার্চে বেঙ্গল রেজিমেন্ট ভেঙে যায়, কোথায় থাকবেন, কী করবেন তা নিয়ে তিনি মহা-ভাবনায় পড়েন। ক্যাম্পে থাকার সময় থেকেই কোলকাতার বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় লেখা পাঠাতেন, সে-সুবাদে কোলকাতার অনেকের সঙ্গে তাঁর পরিচয় ছিল। আবার বাল্য-বন্ধু শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায় তাঁকে আশ্বস্ত করেছিলেন, কাজেই কোনও উপায় না-পেয়ে প্রথমে তিনি শৈলজানন্দের মেসে এসেই ওঠেন। শৈলজানন্দ থাকতেন রমাকান্ত বসু স্ট্রিটে কাশিমবাজার মহারাজের পলিটেকনিক স্কুলের বোর্ডিং-য়ে। আপাতত মাথা গোঁজার মতো একটা আস্তানা তিনি পেয়ে যান।
সেখানেও বিপত্তি। বোর্ডিং-এর ঠাকুর বিদ্রোহ ঘোষণা করে, মুসলমানের এঁটো থালা সে ধোবে না। অন্যান্য বোর্ডাররাও নজরুলের সঙ্গে একাসনে বসে খাওয়া-দাওয়া করতে আপত্তি জানায়। শেষ পর্যন্ত নজরুলকে তো মেস ছাড়তে হয়ই আর শৈলজা, তাঁর প্রিয় বন্ধু নজরুলকে সঙ্গে করে এনেছিলেন বলে, তাঁকেও রেহাই দেওয়া হয় না। শৈলজানন্দের অনুরোধ উপেক্ষা করে নজরুল চলে যান মুজফফর আহমেদের মেসে আর শৈলজানন্দ যান মাতামহের বাড়ি। তিনি নজরুলকেও তাঁর মাতামহের বাড়িতে আনতে চেয়েছিলেন কিন্তু নজরুল রাজি হননি, সম্ভবত মেসের তিক্ত অভিজ্ঞতা তখনও তাঁকে পীড়া দিচ্ছিল। সেটাই তাঁর জীবনে একটি ব্যতিক্রম নয়, বারবারই তাঁকে জাতি-ঘৃণার শিকার হতে হয়েছে। নজরুল অবশ্য তা নিয়ে কোনও দিন কোনও ক্ষোভ দেখাননি, না মুখে না কলমে। তা-হলে কী তাঁর কলম থেকে ওই কালজয়ী পংক্তি বেরোতে পারে- “হিন্দু না ওরা মুসলিম ওই জিজ্ঞাসে কোনজন? কাণ্ডারী। বল ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মার।”৪
মুজফফর আহমেদের মেসে থাকাকালীন বহু পত্র-পত্রিকার সঙ্গে নজরুলের পরিচয় হয়, তাঁর লেখাও বেরোতে থাকে, ওখানের দিনগুলি বেশ ভালো-ভাবেই কাটছিল তাঁর। হঠাৎ ১৯২০ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বরে তিনি দেওঘর চলে যান নির্জন বাসে এবং ডেরা পাতেন কার্তিক বসুর স্বাস্থ্য-নিবাসে। তার মূলেও ছিল এক সরল বিশ্বাস। সেখানে তিনি এক উটকো অপবাদে জড়িয়ে পড়েন। এক তরুণ-তরুণীকে দম্পতি ভেবে এক রাত্রির জন্য তিনি তাঁদের নিজের ঘর ছেড়ে দেন। ওদিকে রাজনারায়ণ বসুর দৌহিত্রী কুমুদিনীর সঙ্গে সেখানেই তাঁর হৃদ্যতা গড়ে উঠেছিল, তিনিই শেষে নজরুলকে অপবাদ দেন তাঁর ওই অপরিণাম-দর্শিতার জন্য। কেন-না নজরুলের এ-হেন বদান্যতা তাঁর ব্রাহ্ম সমাজের পক্ষেও নাকি নিন্দনীয় ছিল। কপর্দক-শূন্য নজরুলকে সেখানকার বাস তুলে দিতে হয়। কিন্তু তাঁর পকেটে কোলকাতা ফেরার মতো পয়সা ছিল না। আফজলউলের কথায় বিশ্বাস করে তিনি এসেছিলেন, কিন্তু তার কাছ থেকে প্রত্যাশিত টাকা আর আসে না, শেষে পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়কে টাকা পাঠানোর জন্য চিঠি লেখেন। ওদিকে মুজফফর আহমেদ তাঁর সন্ধান পেয়ে তাঁকে দুর্যোগ থেকে উদ্ধার করে আনেন ঠিকই কিন্তু আফজলউলের কবল থেকে তাঁকে আর উদ্ধার করতে পারেন না। মুজফফরের নিরাপদ আশ্রয় থেকে আফজলউল তাঁকে ছিনিয়ে এনে মুসলিম সাহিত্য সমিতির অফিসে রাখার ব্যবস্থা করেন। আফজলের ধূর্ততা নজরুলকে স্পর্শ করে না। সেখানে তিনি নতুন করে আলি আকবর খান নামক এক সাহিত্য ব্যবসায়ীর খপ্পরে পড়ে যান। আলি আকবর তাঁকে দিয়ে বিনা-পারিশ্রমিকে শিশুতোষ কবিতা লিখিয়ে নেন এবং বোঝেন ভবিষ্যতে তাঁকে ব্যবহার করে বিশাল অর্থ উপার্জনের সম্ভাবনা রয়েছে। তাই তিনি এক দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ছকেন। কার্যত আকবরের কৌশলে সৈয়দা খাতুন নামে তাঁর এক ভাগ্নিকে তিনি বিয়ে করতে বাধ্য হন। কারও মতে তাঁদের বিয়ে নাকি অসমাপ্ত থাকে। বিস্তারিত ইতিহাস অন্যত্র রয়েছে।৫ নজরুলের ওই ভুলের পরিণতিতে তাঁর যৌবনের এক মূল্যবান অধ্যায় অলস ও উদাসীনতায় ভরে যায়। তিনি চরম আঘাত পান। তার গভীর প্রভাব পড়ে পরবর্তীকালে লেখা তাঁর বহু কবিতায়। এও এক নির্যাতন, শিশু-সরল কবির জীবন নিয়ে ছিনি-মিনি খেলা, মহা সর্বনাশ।
নব-বিবাহিত বধূকে চিরতরে ত্যাগ করে প্রতারিত নজরুল স্নেহের আশ্রয় পান কুমিল্লার বিরজাসুন্দরী দেবীর কাছে। সেখানে ঘনিষ্ঠ হন প্রমীলার সঙ্গে। প্রমীলা তখন তেরো-চোদ্দ বছরের এক কিশোরী। শেষে তাঁর সঙ্গেই নজরুলের বিয়ে হয় ১৫ এপ্রিল, ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দে। ওই অসম ধর্মের বিয়ে নিয়েও নজরুলের কম ভোগান্তি হয় না। নজরুল বিরজাদেবীকে মা বলতেন এবং মায়ের মতো শ্রদ্ধাও করতেন। হুগলি জেলে থাকাকালীন কয়েদিদের প্রতি ব্রিটিশ সরকারের অন্যায্য আচরণের প্রতিবাদে নজরুল আমরণ অনশন শুরু করেন। রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র প্রমুখ তাঁকে অনশন থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করেন। তাঁর মা জাহেদা খাতুনও সুদূর চুরুলিয়া থেকে আসেন। কিন্তু নজরুল মার সঙ্গে দেখা করতে রাজি হন না। শেষে বিরজাদেবীর আদেশেই তাঁকে অনশন ভঙ্গ করতে হয়। বিরজাদেবী নজরুলের কাছে মায়ের অধিক ছিলেন এবং তাঁর প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা অটুট ছিল চিরকাল। গ্রেপ্তার হওয়ার আগে ধূমকেতুর স্বত্বাধিকার বিনা-শর্তে ওই বিরজাদেবীকেই তিনি লিখে দিয়েছিলেন। এ-হেন বিরজাদেবীও নজরুলের বিয়েতে সম্মতি দেননি। বলা বাহুল্য নজরুল তাতে চরম আহত হন।
জেল থেকে বেরিয়ে তাঁকে বহরমপুরের নলিনাক্ষ সান্যালের বাড়িতে কয়েক দিন থাকতে হয়। ওদিকে সান্যালমশাই বিয়ে করবেন না বলতেন কিন্তু শেষ পর্যন্ত সে-সময়েই তাঁকে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয়। তাই নজরুল তাঁর বিয়ের পদ্যে ঠাট্টা করে লেখেন– “বলি, রাখালি রে রাখালি- কত খেলাই দেখালি…।”
নলিনাক্ষের বরযাত্রী সেজে নজরুল যান ভচ্চাজ্জি-বাড়ি। তাঁর গানের সুখ্যাতি তখন দেশব্যাপী। সেখানে হারমোনিয়ম নিয়ে বিয়ের আসর তিনি মাতিয়ে তোলেন। বনেদি বাড়ির পর্দা-প্রথা ভেঙে মহিলারা বাইরে এসে সশ্রদ্ধ-ভাবে তাঁর গান শুনতে থাকেন। কিন্তু বিপত্তি হয় বরযাত্রীদের খেতে দেওয়ার সময়। নজরুলের সঙ্গে হিন্দুরা একাসনে বসতে রাজি হন না।
অথচ বিয়ের আগেই নলিনাক্ষ সান্যালের একটা শর্ত ছিল যে, জাতি-ভেদ মেনে তাঁর নিমন্ত্রিতদের অপমান করা চলবে না। নলিনাক্ষবাবু পড়লেন মহা ফাঁপড়ে। নজরুল ওই অযাচিত আঘাতে নীরব হয়ে রইলেন কিছু ক্ষণ। তার পরই কী ভেবে হারমোনিয়ম তুলে নিয়ে মহা-উৎসাহে আবার গেয়ে উঠলেন– “জাতের নামে বজ্জাতি সব, জাত জালিয়াৎ খেলছে জুয়া…।”
আবার এরকমের আরও একটি ঘটনা ঘটে নজরুলের বাসা-বাড়ি নিয়ে। সীতানাথ ঘোষ রোডে ধূমকেতুর ম্যানেজার শান্তিপদ সিংহ মশায়ের নামে একটি বাড়ি ভাড়া নেওয়া হয়। নজরুল সপরিবার ওই বাড়িতে বাস করতে থাকেন। হঠাৎ বাড়ি-ওয়ালা জানতে পারেন তাঁর বাড়িতে মুসলিম বাস করছে। তিনি ক্ষেপে যান। নজরুল নীরবে ওই বাড়ি ত্যাগ করে উঠে যান হরিঘোষ স্ট্রিটে।
হরিঘোষ স্ট্রিটে তাঁর এক ভক্তের অসমাপ্ত বাড়ি দেখে নজরুল বেশ খুশি ছিলেন, স্ত্রী-সহ সেখানে উঠবেন বলে কিছু অগ্রিম-ভাড়াও দিয়ে রেখেছিলেন। কিন্তু বিপত্তি হয় পাড়া প্রতিবেশীদের নিয়ে। তাঁরা অনেকে গোঁড়া ব্রাহ্মণ। মুসলিম এলে পাড়ার শুচিতা নষ্ট হবে, তাই তাঁদের মুখর প্রতিবাদের ঝড় বইতে শুরু করে। নজরুল তবুও ওবাড়িতে ওঠেন এবং কয়েক মাসের মধ্যেই তাঁর মধুর ব্যবহার ও সুরের ঝঙ্কারে ওই ব্রাহ্মণ প্রতিবেশীদের বশংবদ করে ফেলেন। পরে ওই বাড়ি ছেড়ে তিনি যখন অন্যত্র উঠে যাচ্ছেন তখন তাঁরাই আবার চোখের জল ফেলতে বসেন।
মুসলিমদের প্রতি হিন্দুদের চরম ঘৃণার আরও এক দুঃখজনক উল্লেখ রয়েছে নজরুলের দুটি চিঠিতে। তিনি ওই ঘটনার সঙ্গে নিজেই জড়িত ছিলেন। এখানে তাঁর ভাষাতেই উদ্ধৃতি দেওয়া যেতে পারে। “এর মধ্যে একটা মজা হয়ে গেছে। তেমন কিছু নয়, তবুও তোমায় লিখছি। দৈনিক বসুমতীতে দিন কতক আগে একটা বিজ্ঞাপন বেরিয়েছিল যে, কোন ব্রাহ্মণ ভদ্রলোক মৃত্যু শয্যায় শায়িত- কোনো সুস্থকায় যুবকের কিছু রক্ত পেলে তিনি বাঁচতে পারেন। তিনি কলকাতাতেই থাকেন। আমি রাজি হয়েছি রক্ত দিতে। আজ ডাক্তার পরীক্ষা করবে আমায়। আমার দেহ থেকে রক্ত ওর দেহে দেবে। ভয়ের কিছু নেই এতে, তবে দু’চার দিন শুয়ে থাকতে হবে মাত্র।”
পরের চিঠিতে….. “রক্তদান করিনি। ডাক্তার শালা বলে হার্ট দুর্বল। শালার মাথা! মনে হচ্ছিল একটা ঘুষি দিয়ে দেখিয়ে দিই কেমন হার্ট দুর্বল। ভিতরের কথা তা নয়। ব্রাহ্মণ ভদ্রলোক মুসলমানের রক্ত নিতে রাজি হলেন না! হায়রে মানুষ; হায় তার ধর্ম! কিন্তু কোন হিন্দু যুবক আজও রক্ত দিলে না। লোকটা মরছে- তবুও নেবে না নেড়ের রক্ত।…”৬ হিন্দুদের কাছ থেকে এ-রকমের আঘাত-পাওয়ার বহু নজির আছে। অন্য দিকে মুসলমানেরাও তাঁকে ছেড়ে কথা বলেননি কোনও দিন। কার্যত তিনি দুই সম্প্রদায়ের কাছ থেকেই জীবন-ভর নির্মম আঘাতই শুধু পেয়ে গেছেন।
আবার সাহিত্যিক জীবনেও নজরুল স্বস্তি পাননি। এক দিকে ঈর্ষাকাতর কবিরা তাঁর কবিতা নির্মাণের ত্রুটি নিয়ে সমালোচনা শুরু করেন অন্য দিকে মৌলবাদীরা তাঁর কবিতার মধ্যে হিন্দুবাদী গন্ধ পান। এমনকী অশ্লীলতার দায়েও কবিকে অভিযুক্ত করা হয়। একখানি উচ্চমানের পত্রিকার সম্পাদিকা, এক জন কবি ও এক জন রাজনৈতিক নেতা তাঁকে হেয় করার জন্য রচনা করেন- কবি-লীলা না কৃষ্ণ-লীলা? সে-প্রসঙ্গে জুলফিকর হায়দার লেখেন- উক্ত পুস্তিকায় এমনি অশ্লীল ও জঘন্য ভাষায় আক্রমণ করে কবিকে হেয় প্রতিপন্ন করার চেষ্টা হয়েছিল যে তিনি সে-আক্রমণ সহ্য করতে পারলেন না, পুস্তিকাটির প্রারম্ভের দিকটার ভাষা পড়েই সিঁড়ির উপরই দাঁড়ানো থেকে বসে পড়লেন। ১৩২৯ বাংলা সালে ইসলাম দর্শন পত্রিকায় নিয়ন্ত্রিত নামে দীর্ঘ এক কবিতায় নজরুলকে ব্যঙ্গ করে গোলাম মোস্তফা লেখেন- “তুমি বুলবধূর বস্ত্রাপহারী দুর্মতি দুঃশাসন ।…… বলি মাঝে মাঝে অভ্যাস আছে খাওয়া কি গাঞ্জা?” আবার তাঁর লেখা মাধবী প্রলাপ কবিতা কালিকলমের ১৩৩৩ সালের জ্যৈষ্ঠ সংখ্যায় ছাপানো হয়। শনিবাবের চিঠির দল কবিতাটির মধ্যে অশ্লীলতা আবিষ্কার করেন এবং পুলিশের কাছে অভিযোগ দাখিল করেন। পরিণামে কালিকলমের সম্পাদক ও প্রকাশককে কয়েকদিন পুলিশি হয়রানি সামাল দিতে হয়। ব্যাপারটি এখানেই শেষ হয় না। সৌমেন্দ্র নাথ ঠাকুরের সঙ্গে নজরুলের সৌহার্দ্য ছিল। তাঁকেও নজরুলের বিরুদ্ধে উত্তেজিত করা হয় এবং তিনি উত্তেজিত হয়ে কালিকলমের ফাল্গুন সংখ্যাতেই একটি নৈতিক ফতোয়া জারি করে কার্যত নজরুলকে ভর্ৎসনা করেন। ১৩৩৪ ভাদ্র সংখ্যা শনিবারের চিঠিতে মোহিতলাল মজুমদার সত্যসুন্দর দাস ছদ্ম-নামে নজরুলকে যা-ইচ্ছে তাই বলে চিত্রিত করেন। “তাঁহার কাম-তৃষ্ণা কোনো নাম নির্দিষ্টা নায়িকাতে আবদ্ধ নহে… নারী মাত্রেই তাঁর সেই অনামিকা প্রেয়সী কেন না তাহাদের কোনো ব্যক্তিগত পরিচয়ের ধার তিনি ধারেন না। তাঁহারা সেই এক ও অভিন্ন রতিরসের পাত্র বই তো নয়? অতএব তিনি কামের পাত্র বিচার করেন না- এ বিষয়ে তিনি একরকম pan মৈথুন ist.।” নজরুলের দিলদরিয়া সুলভ ব্যক্তিত্বের অপরাধেই বুঝি তাঁকে কেউ-ই ছেড়ে কথা বলেননি।
বিভিন্ন শ্রেণি কিংবা সম্প্রদায়ের কাছ থেকে তিনি ছাড়া আর কোনও খ্যাতনামা বাঙালি কবি এমন নির্মম ভাবে নির্যাতিত হয়েছেন বলে জানা নেই। তিনিই একটি ব্যতিক্রম। তাঁকে সামনে রেখে প্রকাশ্যে তাঁর প্রতি যে-ব্যঙ্গাত্মক অশ্রদ্ধা প্রদর্শিত হয়েছে তার পুরো বিবরণ লিখতে হলে একটি পূর্ণাবয়ব বই-ই হয়ে যায়। বলা বহুল্য প্রতিটি শরই কবির কোমল হৃদয়কে রক্তাক্ত করেছে, নীরবেই তিনি তা সহ্য করে গেছেন। এখানে তাঁর সাহিত্য জগতের নির্যাতন বিষয়ে সামান্য কিছু তথ্য তুলে ধরা হল মাত্র।
১৯২২ খ্রিস্টাব্দের ১১ অগস্ট নজরুল ধূমকেতু নাম দিয়ে পত্রিকা প্রকাশ করেন। এক দল মানুষ কবি সম্পাদিত ওই ধূমকেতু পত্রিকার সঙ্গে ব্যক্তি-কবিকেও আক্রমণ করার জন্য কোমর বেঁধে লাগেন। ইসলাম দর্শন-এর আশ্বিন, ১৩২৯ সংখ্যায় সে-রকমের একটা নজির রয়েছে।….. “ইহা বাঙ্গালার কুশিক্ষিত চিরচঞ্চল চিত্তাকাশ বিচরণকারী একখানি অর্ধ সাপ্তাহিক ব্যঙ্গপত্র।… একটি জীবন্ত অপগ্রহ।…… প্রকৃত ধূমকেতু হইতেও অধিক ভয়ঙ্কর কিন্তু দুষ্টাত্মা অভিশপ্ত শয়তানকে কেমন করিয়া বিতাড়িত ও দূরীভূত করিতে হয়, তাহা মুসলমানরা ভাল মতোই অবগত আছেন…..।”
পরের সংখ্যায় আবার বিষোদগার।…… “ব্যোম কেদার, ব্যোম ভোলানাথ, হল বলরাম স্কন্ধে, বোল হরিবোল প্রভৃতি কোফরী কালাম এত অধিক পরিমাণে নির্গত হইতেছে…. কেবল হিন্দু পুরাণের চর্বিত চর্বণে ক্ষান্ত না থাকিয়া পবিত্র ইসলাম ধর্ম ও ইসলামি শরা-শরীয়তের উপর শয়তানি আক্রমণ আরম্ভ করিয়া দিয়াছে।….. ধূমকেতু প্রত্যেক সংখ্যায় পবিত্র ইসলাম ধর্মের বিরুদ্ধে গরল উদগীরণ করিতেছে।… হিন্দুয়ানি মাদ্দায় ইহার মস্তিষ্ক পরিপূর্ণ…..। দুঃখের বিষয় অজ্ঞান যুবক এখনও আপনাকে মুসলমান বলিয়া পরিচয় দিতেছে…. কাজির পোর যখন পুনর্জন্মের বিশ্বাসটা এত দৃঢ় আর হিজড়ে নপুংসকগুলোর মুখ দেখেই তাকে নিশ্চয় মরতে হবে… লোকটা শয়তানের পূর্ণাবতার। ইহার কথা আলোচনা করিতেও ঘৃণা বোধ হয়।…এইরূপ ধর্মদ্রোহী কুবিশ্বাসীকে মুসলমান বলিয়া গ্রহণ করা যাইতে পারে না,…… খাঁটি ইসলামি আমলদারি থাকিলে এই ফেরাউন বা নমরুদকে শূল বিদ্ধ করা হইত বা উহার মুণ্ডপাত করা হইত নিশ্চয়……” (অরুণ বসু পৃ ১২০-২৪)। প্রচুর ঘটনার মধ্যে এখানে মাত্র দুটির আংশিক উল্লেখ করা হয়েছে। তা-থেকেই বোঝা যায় নজরুল এ-যুগের মানুষ হলে তাঁর জীবিত কিংবা মৃত মাথার দাম অনেকটাই বেড়ে যেত যেমন রয়েছে এ-যুগের কয়েক জন লেখক বা লেখিকার বেলায়।
সকলেই জানেন, নজরুল হিন্দু মেয়ে বিয়ে করেছিলেন। তা-নিয়ে হিন্দু এবং মুসলমান দুই সমাজেই কম ঝড় বয়ে যায়নি। ছোলতান পত্রিকায় (১১ এপ্রিল, ১৯২৪) লেখা হয়– “সুতরাং হিন্দু মহিলার পাণিগ্রহণ করিয়া কাজীছাহেব হিন্দু মোছলেম প্রীতির যত বড় প্রচারকই হোক না কেন, মোছলমান সমাজ তাঁকে চায় অন্যভাবে। তিনি বাংলা কাব্যে এছলামি রূপ দিয়া, তাহাতে মোছলমানি প্রাণের প্রতিষ্ঠা করিবেন, মোছলমান সমাজ কাজীর নিকটে তাহাই চায়…., যাক, কাজীছাহেব তাঁর বিবাহিত জীবনে মোছলমানি বৈশিষ্ট্য হারাইয়া ফেলিবেন, ইহা আমাদের অনুমান মাত্র।”৭
ওদিকে ব্রাহ্মরা আগে থেকেই নিজেদের সংস্কারমুক্ত, উদারপন্থী এবং প্রগতিবাদী বলে প্রচার করে রেখেছিলেন কিন্তু হিন্দু কন্যাকে বিধর্মীর হাতে তুলে দিতে তাঁদের ওই ঔদার্যের ভাণ্ডারে ঘাটতি দেখা যায়। তাঁরাও প্রতিবাদে মুখর হয়ে ওঠেন। প্রবাসী পত্রিকা ও-রকমের প্রগতিশীল বলে পরিচিত ছিল। ওই পত্রিকায় নজরুলের লেখাও প্রকাশিত হত। হিন্দু-কন্যাকে বিয়ের পরে নজরুলের কাছে সে-দরজা শুধু বন্ধই হয় না প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে ওই পত্রিকার মাধ্যমেই নজরুলের বিরুদ্ধে বিষোদগারও অব্যাহত থাকে। নজরুল প্রয়াত চিত্তরঞ্জন দাশকে উৎসর্গ করে একটি কাব্য-গ্রন্থ লিখেছিলেন। ওই বইটিতে নজরুলের একটি ছবিও ছাপা হয়েছিল। তাতে ক্ষিপ্ত হয়ে প্রবাসী মাঘ ১৩৩২ সংখ্যায় লেখে– “চল্লিশ পাতা বই-এর দাম এক টাকা। খুব সস্তা নয়।… তবে পুস্তকের গোড়াতেই কাজী সাহেবের গোঁফে-চাড়-দেওয়া এবং বিষ্ণুপুরের দলমাদল কামানের গায়ে হেলান দেওয়া অবস্থায় তোলা ফোটোগ্রাফের নকল দেখিবার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। দেশবন্ধু দাশের ছবি কোথাও নাই-ইহা অত্যন্ত অশোভন হইয়াছে এবং বই বিক্রির দিক হইতেও ইহা বুদ্ধির পরিচায়ক হয় না….।”৮ ওদিকে তাঁর গ্রামের আত্মীয়-স্বজনেরাও ছেড়ে কথা বলেননি, তারাও বেঁকে বসেন। কাজেই বিয়ে নিয়ে নজরুলকে প্রচুর লাঞ্ছনা ভোগ করতে হয়।৯
১৩৩১, ২৮ ভাদ্র সংখ্যা শনিবারের চিঠিতে ভাব কুমার প্রধান ছদ্ম নাম নিয়ে সজনীকান্ত দাস স্বয়ং চিঠির আকারে একটি ব্যঙ্গ কবিতা প্রকাশ করেন। তাতে নজরুলকে জাতীয় মহাকবি গাজী আব্বাস বিটকেল নামে সম্বোধন করা হয়–
ওরে ভাই গাজী রে কোথা তুই আজি রে
কোথা তোর রসময়ী জ্বালাময়ী কবিতা।
কোথা গিয়ে নিরিবিলি ঝোপেঝাপে ডুব দিলি
তুই যে রে কাব্যের গগনের সবিতা।…
দাবানল বীণা আর জহরের বাঁশিতে
শান্ত এ দেশে ঝড় একলাই তুললি,
পুষ্পক দোলা দিয়া মজালি যে কত হিয়া
ব্যথার দানেতে কত হৃদি দ্বার খুললি।
সাহিত্য-জগতে তাঁর প্রতিভাকে আক্রমণ করতেই নাকি শনিবাবের চিঠি নামক সাপ্তাহিক পত্রিকার আবির্ভাব হয়। সজনীকান্ত নজরুলের লেখা বিদ্রোহী কবিতার ব্যঙ্গে লিখলেন ‘ব্যাং’–
আমি ব্যাং, লম্বা আমার ঠ্যাং,
ভৈরব রভসে বরষা আসিলে ডাকি যে গ্যাঙোর গ্যাং।
নজরুল ভাবেন ওই কবিতা মোহিতলালের লেখা। তার একটা কারণও ছিল। নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি মোহিতলালের ‘আমি’ গদ্যাংশের ভাবানুকরণ ধরে নিয়ে মোহিতলালের সঙ্গে নজরুলের এক কিস্তি মন-কষাকষি তার আগেই হয়ে গেছে। নজরুল বিভ্রান্ত হয়ে মোহিতলালের উদ্দেশে ‘সর্বনাশের ঘণ্টা’ নামক একটি কবিতা লিখে পুনরায় বিরোধে লিপ্ত হন। এ-ধরনের নজরুল বিরোধিতা বিষয়ক ঘটনার প্রচুর দৃষ্টান্ত আছে যেমন- ‘বাগিচায় বুলবুলি তুই’ গানকে ব্যঙ্গ করে লেখা হয় ‘জানলায় টিকটিকি তুই’। কেবলরাম গাজনদার ছদ্মনামে কেউ একটি পঞ্চাঙ্ক নাটক লেখেন, ‘কচি ও কাঁচা’। সেখানে নজরুলকে ব্যঙ্গ করে কবি বায়রন সাজানো হয়। অন্য দিকে তাঁর লেখা দু’টি কাব্য গ্রন্থ ‘পূবের হাওয়া’ ও ‘ছায়ানট’-য়ে প্রায় বাইশটি কবিতার পুনর্মুদ্রণ ঘটে। সেজন্য ২৭ নভেম্বর, ১৯২৫ সংখ্যার মোহম্মদী পত্রিকায় তাঁকে ব্যবসাদার কবি বলে অপবাদ দেওয়া হয়। ওই কলঙ্ক কবির জীবনে দুর্ভাগ্য বই কিছু নয়। কবি যদি সত্যিই ব্যবসার বিন্দু-বিসর্গও বুঝতেন তা-হলে জীবনে প্রচুর সুযোগ পাওয়া সত্ত্বেও তাঁকে কার্যত ভিখারীর মতো অন্যের কাছে অর্থ-ভিক্ষা করতে হত না। তাঁকে ভাঙিয়েই অনেকে বিত্তবান হয়েছেন কিন্তু কবি রয়ে গেছেন যে দরিদ্র সে দরিদ্রই। তাঁর দেওয়া সুর চুরি করে কত গায়ক যে তরে গেছেন তার ইয়ত্তা নেই। তাঁর গান-লেখা খাতাগুলি চুরি হয়ে-যাওয়া ছিল নিত্য-নৈমিত্তিক ঘটনা। তাঁর লেখা গান ও সুর অন্যেরা নিজেদের নামে চালিয়ে দিত তবু নজরুল নির্বিকার থাকতেন। একবার প্রণব রায় সম্পর্কে সে-রকমের চুরির একটা অভিযোগ ওঠে। প্রণব রায়কে জিজ্ঞেস করলে তিনি তা স্বীকারও করেন। শুনে নজরুল হাসতে হাসতে তাঁকে জড়িয়ে ধরেন। প্রণব রায় তখন সাহস পেয়ে বলেন– সমুদ্র থেকে এক আধ গণ্ডুষ জল নিলে সমুদ্রের কী ক্ষতি হয় বলুন? (মুক্ত আকাশ স্বর্ণপক্ষ ঈগল : নিতাই ঘটক : কাফেলা) আর এক দফা হাসি। এমনি উদার ছিল নজরুলের মন। ব্যবসায়ী হতে তিনি আর পারলেন কোথায়, শুধু অপবাদই পেয়ে গেলেন।
নজরুলকে রবীন্দ্র বিরোধী বলতেও অনেকের বিবেকে বাধেনি। অথচ রবীন্দ্রনাথকে সত্যই তিনি গুরুদেবের মতো শ্রদ্ধা করেছেন সারাজীবন। কার্যত তিনি রবীন্দ্রনাথকে সাহিত্যের অভিভাবক বলে মনে করতেন। কিন্তু ঘটনা ঘটল উল্টো, নজরুলের প্রতিবাদ মূলক লেখা ‘সর্বনাশের ঘণ্টা’ কবিতাটি নাকি রবীন্দ্রনাথের উদ্দেশে লেখা হয়েছে বলে, প্রচার করা হল। আবার নজরুলের বিরুদ্ধে রবীন্দ্রনাথের কাছে অনেকে নানা ভাবে নালিশও জানালেন। তার মধ্যে যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত, নীরোদচন্দ্র চৌধুরী, মোহিতলাল মজুমদার, সজনীকান্ত দাস প্রমুখের নাম বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য। একবার ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দের ১৩ ডিসেম্বর প্রেসিডেন্সি কলেজে সংবর্ধনার প্রত্যুত্তরে এক বক্তৃতায় রবীন্দ্রনাথ বলেন– “সেদিন কোনও এক জন বাঙালি হিন্দু কবির কাব্যে দেখলুম, তিনি রক্ত শব্দের জায়গায় ব্যবহার করেছেন ‘খুন’। পুরাতন রক্ত শব্দে তাঁর কাব্যে রাঙা রঙ যদি না ধরে তা হলে বুঝব, সেটাতে তাঁরই অকৃতিত্ব।” শনিবারের চিঠি ও বাংলার কথা, দুটি পত্রিকাতেই উদ্দেশ্য প্রণোদিত ভাবে ‘বাঙালি হিন্দু কবির কাব্যে’র পরিবর্তে ‘বাঙালি কবির কাব্যে’ লেখা হয়, অর্থাৎ রবীন্দ্র নাথ যেন নজরুলের উদ্দেশেই ওই কথাক’টি বলেছিলেন, লেখার ধরনটা সেরকমেরই হয়ে দাঁড়ায়। নজরুলও ভুল বোঝেন এবং ঐতিহাসিক প্রবন্ধ ‘বড়োর পিরিতি বালির বাঁধ’ লিখে তার জবাব দেন। যা-হোক শেষ পর্যন্ত প্রমথ চৌধুরীর লেখা একটি প্রবন্ধের মধ্যস্থতায় নজরুল আসল ঘটনা বুঝতে পারেন বলেই তিনি রবীন্দ্র স্নেহ থেকে কোনও দিনই বঞ্চিত হননি। বঞ্চিত যে-হননি, তার একটা চমৎকার উদাহরণ আছে। দেবদত্ত ফিল্মস্ গোরার চিত্ররূপ তোলেন। নজরুল ওই চিত্রের সঙ্গীত পরিচালক ছিলেন এবং সে-চিত্রে তিনি রবীন্দ্র সংগীত ব্যবহার করেন। চলচ্চিত্রটি মুক্তি পাবার দিন দুই আগে বিশ্বভারতী থেকে পর্যবেক্ষক এসে রবীন্দ্র সংগীতের ব্যবহার নিষিদ্ধ করে দেন। নজরুল কী করেন, তিনি চলচ্চিত্রের একটি কপি ও প্রোজেক্টর মেসিন নিয়ে হাজির হন রবীন্দ্রনাথের কাছে। রবীন্দ্রনাথ দেখে-শুনে বলেন– “সেকী। তোমার চেয়ে আমার গানের মানে কি অন্যেরা বেশি বুঝবে? দাও, অনুমতি-পত্রে স্বাক্ষর করে দিচ্ছি।” কিছু না-পড়েই রবীন্দ্রনাথ অনুমতি পত্রে সই দিয়ে দেন। চলচ্চিত্র নিয়ে নজরুল-বঞ্চনার ইতিহাস দীর্ঘ। এখানে তাঁর একটি ধ্রুব নামে সবাক্ চিত্র তৈরি করে ম্যাডান কম্পানি। ওই কম্পানির অধীনে নজরুল ও নিতাই ঘটক যথাক্রমে মাসিক পাঁচ-শো ও পঞ্চাশ টাকা বেতনের চুক্তি-পত্রে স্বাক্ষর করেন। কিন্তু চুক্তির সময় ছাড়া তাঁরা আর কোনও সময়ই কোনও মাইনে পান না। নিতাইবাবু উকিলের চিঠি দিয়ে মামলার হুমকি দেন। নজরুল কিন্তু নীরব থাকেন এবং তাঁর স্বভাব-সুলভ ভঙ্গিতে সব ক্ষমা করে দেন। বলা বাহুল্য এ-রকমের উটকো অশান্তিও তাঁর আত্মভোলা জীবনের এক একটি নির্যাতন বই আর কিছু নয়। তিনি সারাটি জীবন শুধু ব্যথাই বয়ে গেলেন। ১০
নজরুলকে বলা হয় বিদ্রোহী কবি। অনাচারের বিরুদ্ধে তাঁর বিদ্রোহ। তাঁর কালে ভারতের শাসন-কর্তা ছিল ইংরেজ। তাঁদের বিরুদ্ধে তাঁর জেহাদ স্বভাবতই উচ্চারিত হয়েছে বিভিন্ন কবিতা তথা প্রবন্ধে। তিনি তৎকালিক কংগ্রেস অধিবেশনের উদ্বোধনী সংগীত রচনা করেছেন এবং স্বয়ং তা গেয়েছেন, ধূমকেতুতে সর্ব প্রথম ঘোষণা করেছেন স্বরাজ নয়-পূর্ণ স্বাধীনতার আহ্বান, কৃষ্ণনগরে থাকাকালীন বহু বিপ্লবী তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন, ওখানে তিনি যুবকদের প্যারেড শেখাতেন (স্বাধীনতা সংগ্রামে নদীয়া : নদীয়া জেলা নাগরিক পরিষদ, ১৯৭৩)। অর্থাৎ এক জন নির্ভেজাল স্বদেশী বলে তাঁকে চিহ্নিত করতে কারও কোনও অসুবিধে হওয়ার কথা নয়। কিন্তু, লখনউতে ১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দের ১০ এপ্রিল নিখিল ভারত প্রগতি লেখক সংঘ প্রথম প্রকাশ্য অধিবেশনে ফ্যাসি শক্তির বিরুদ্ধে শিল্পী সাহিত্যিকদের সংঘবদ্ধ করার উদ্যোগ নেয়, প্রেমচাঁদ মুন্সী এগিয়ে আসেন। ১১ জুলাই গোর্কির মৃত্যুতে আহৃত সভায় বঙ্গীয় লেখক সংঘ গঠিত হয়। ২৮ জুলাই জহরলালের অনুরোধে রবীন্দ্রনাথ ন্যাশানাল কাউন্সিল অফ সিভিল লিবার্টিস ইউনিয়নের সভাপতির পদ গ্রহণ করেন। ভারত বিভাগের বিরুদ্ধে গণ-আবেদনে প্রথম স্বাক্ষর দেন রবীন্দ্রনাথ। ওই ঘটনাগুলি ঘটে। কী আশ্চর্য! ওসবের কোথাও ইংরেজ-বিদ্রোহী নজরুলের নাম-গন্ধ নেই। দেশের মানুষ তাঁকে তাঁর প্রাপ্য সম্মান থেকে বঞ্চিত করলেও ভারতের নির্ভীক স্বেচ্ছা-সৈনিক নজরুল কিন্তু কোনও দিন তা নিয়ে কোনও অভিযোগ তোলেননি। এটা আরও আশ্চর্য।
অথচ ইংরেজ বিরোধিতার ফলে তাঁর বহু বই-ই বাজেয়াপ্ত হয়। ধূমকেতুতে প্রকাশিত কবিতার জন্য ধূমকেতু শুধু বাজেয়াপ্তই হয় না, তাঁকে জেলেও যেতে হয়। ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে (মুজফফর আমেদের মতে অক্টোবর মাসে প্রকাশিত) লেখা তাঁর প্রথম নিবন্ধের বই যুগবাণী, সরকার কর্তৃক নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়। কারণ হিসেবে বলা হয়- প্রবন্ধগুলিতে ইংরেজের বিরুদ্ধে ভারতীয়দের উস্কানি দেওয়া হয়েছে এবং তীব্র ভাষায়।১১ ১৯২২ থেকে ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে লেখা তাঁর পাঁচটি বই নিষিদ্ধ হয়।১২ বিষের বাঁশি শুধু নিষিদ্ধই হয় না, তার কোনও কপি আছে কিনা খোঁজ করতে গিয়ে কবির হুগলি-বাড়িতেও হানা দেয় পুলিশ। খানা-তল্লাসি করে সেখানে অবশ্য বিষের বাঁশির একটি কপিও পাওয়া যায় না। আর এ-সব ব্যাপারে ইংরেজের হয়ে নজরদারি করতেন আমাদের দেশের মানুষেরাই। ওই বিষের বাঁশি সম্পর্কে ইংরেজ সরকারকে অবহিত করান বেঙ্গল লাইব্রেরির লাইব্রেরিয়ান অক্ষয় কুমার দত্তগুপ্ত। নজরুল সম্পর্কে আসল তথ্য হল, একক লেখক হিসেবে সমসাময়িক কালে তাঁর রচনাই সব চেয়ে বেশি শাস্তি-প্রাপ্ত। নিছক সংখ্যার দিক থেকে অন্য কোনও লেখকের নিষিদ্ধ গ্রন্থের সংখ্যা বেশি হলেও নজরুলের মতো তাঁরা সমাজে প্রভাব বিস্তার করতে পারেননি। সেগুলি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পুস্তিকা ধরনের, প্রায়শই বক্তৃতা-ধর্মী। মজার কথা নজরুলের লেখা বই নিষিদ্ধ হয় বটে তবে বিক্রি বন্ধ হয় না। সভায় সমিতিতে তাঁর নিষিদ্ধ বইগুলি প্রায় প্রকাশ্যেই বিক্রি হয়েছে অকাতরে। কিন্তু সে-গোপন বিক্রির উদার মুনাফার একটি শীর্ণ অংশও নজরুলের হাতে আসে না (অচিন্তকুমার সেনগুপ্ত : জৈষ্ঠের ঝড় : পৃষ্ঠা১৭৮)। অথচ কোনও দিনই তাঁর অর্থ-কষ্টের ঘাটতি ছিল না। শৈলজানন্দের লেখায় দেখা যায় নজরুলের তখন যা অবস্থা তাকে ঠিক বেঁচে থাকা বলে না। সবাই হৈ হৈ করছে, টানাটানি করছে, বলছে গান গাও, কবিতা শোনাও, বাহবা দিচ্ছে প্রশংসা করছে। কিন্তু কী খেয়ে কেমন করে সে বেঁচে আছে, সে দিকটা কেউ দেখছে না। একটা পয়সাও আসছে না কোথাও থেকে। কী কষ্টে তার দিন চলছে, তা জানি এক মাত্র আমি। কবিতার জন্য দশটি টাকার বেশি কেউ দিতে চায় না, কবিতার বই কেউ ছাপতে চায় না। উপরিলিখিত সবকটি ঘটনাই কিন্তু নজরুল-বঞ্চনা ও নজরুলের দেশ-প্রিয়তার নজির তবু তাঁর নাম স্বাধীনতাকামী কিংবা স্বাধীনতা সংগ্রামী-সংস্থার কোনও তালিকায় ওঠেনি। এর চেয়ে বেশি অবাক হওয়ার বিষয় আর কী থাকতে পারে!
নজরুল লিখতেন বাংলা ভাষায়। ইংরেজদের পক্ষে সে-ভাষা বোঝার কোনও উপায় ছিল না সত্যই কিন্তু তাঁদের তোষামোদকারী বাঙালি দালালের সংখ্যা সেকালেও কম ছিল না। তাঁদের অনেকে আবার ছিলেন সরকারি উচ্চ পদের অধিকারী। তাঁরাই নজরুলের বইগুলি পড়ে তাঁদের ধ্যান-ধারণা অনুযায়ী আপত্তিকর অংশগুলি দাগ দিয়ে সরকারের গোচরে আনতেন এবং বাজেয়াপ্ত করার সুপারিশ করতেন। এক কথায় নজরুল তাঁর স্বদেশবাসীর কাছ থেকেই নির্যাতিত হয়েছেন সব চেয়ে বেশি। এর মধ্যে অন্যতম ছিলেন তৎকালিক পাবলিক প্রসিকিউটার রায় বাহাদুর তারকনাথ সাধু।১৩ তাঁর চিঠির ভিত্তিতে পুলিশ কমিশনার চিফ সেক্রেটারির কাছে এক আদেশে নজরুলকে ফৌজদারি দণ্ডবিধির ১৯৬ ধারা অনুসারে অভিযুক্ত করার সুপারিশ করেন এবং শেষ পর্যন্ত ছ’মাসের কারাদণ্ডের আদেশ দেওয়া হয়। সৌভাগ্য ক্রমে গান্ধী-আরউইন চুক্তির সুবাদে নজরুলকে সে-যাত্রা আর কারাবরণ করতে হয় না।
তবে কারাবরণের হাত থেকে নজরুল রেহাই পাননি তাঁর সম্পাদনায় প্রকাশিত ধুমকেতুর দু’টি লেখার জন্য। ধূমকেতু প্রথম প্রকাশিত হয় ১২ অগস্ট, ১৯২২। ২৬ সেপ্টেম্বর সংখ্যায় নজরুলের আনন্দময়ীর আগমনে এবং লীলা মিত্রের বিদ্রোহীর কৈফিয়ৎ কবিতা দুটির জন্য ৮ নভেম্বর নজরুলের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়। নজরুল ১৬ জানুয়ারি ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দ থেকে এক বছরের জন্য কারাগারে নিক্ষিপ্ত হন। হুগলি জেল থেকে বহরমপুর জেলে স্থানান্তকরণের সময় নৈহাটি স্টেশনে তাঁকে কয়েদির বেশে কোমরে দড়ি-বাঁধা অবস্থায় অনেকে দেখেন এবং তাঁরা শোকাহত হন। বহরমপুরে তাঁকে সলিটরি জেলে রাখা হয়। কবির হাতে লোহার চেন পরিয়ে তাঁকে দেওয়ালের সঙ্গে বেঁধে রাখা হত। অসহ্য গরমে সারা রাত তিনি ঘুমোতে পারতেন না, আকাশে তারাদের গমন পথ লক্ষ করে রাতটা কোনও মতে কাটিয়ে দিতেন। মুক্তির সময় আবার একটা উটকো ঝামেলা। ১৫ ডিসেম্বর নজরুলের ছাড়া-পাওয়ার দিন। প্রতিহিংসা-পরায়ণ ইংরেজ শাসক তার দুদিন আগেই তাঁর বিরুদ্ধে জেলের আইন-ভঙ্গের মিথ্যা অভিযোগ এনে তাঁকে কোর্টে হাজির করে। শুরু হয় নতুন মামলা। সৌভাগ্য বশত বিচারক তাঁকে নির্ধারিত দিনেই মুক্তি দেন কেন-না তাঁর বিরুদ্ধে ওই নতুন অভিযোগটি ধোপে টেকে না।
অবস্থাটা এমন দাঁড়িয়েছিল যে, সে-যুগে প্রকাশক মহল নজরুলের কোনও বই প্রকাশ করতে গিয়ে দশ বার ভাবতেন। কেন-না তাঁদের ধারণা হয় নজরুল মানেই সরকারি রোষ। যেমন– প্রলয় শিখার পাণ্ডুলিপি দেখে প্রকাশকেরা বুঝেছিলেন, এ-বই প্রকাশিত হলেই দেশ ব্যাপী ঝড় বয়ে যাবে আর ইংরেজ সরকার তা কোনও মতেই সহ্য করবে না। তাই তাঁরা বইটি প্রকাশ করতে রাজি হন না। নজরুল স্বয়ং মুদ্রাকর ও প্রকাশক হয়ে অগস্ট ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে বইটি ছাপেন। যা ভাবা গেছিল তাই হল। শেষ পর্যন্ত বইটি বাজেয়াপ্ত হয় এবং নজরুল রাজদ্রোহের অভিযোগে অভিযুক্ত হন।১৪
দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ প্রয়াত হন ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দের ১৬ জুন দার্জিলিং-য়ে। নজরুল তাঁর প্রতি গভীর শ্রদ্ধায় ইন্দ্রপতন নামে একটি কবিতা প্রকাশ করেন আত্মশক্তি ১২ আষাঢ় ১৩৩২ সংখ্যায়।১৫
… ইব্রাহিমের মতো বাচ্চার গলে খঞ্জর দিয়া
কোরবানী দিলে সত্যের নামে, হে মানব নবী-হিয়া!
ফেরেস্তা সব করিছে সালাম, দেবতা নোয়ায় মাথা,
ভগবান বুকে মানবের তরে শ্রেষ্ঠ আসন পাতা!……
… ‘জন্মিলে তুমি মহামদের আগে হে পুরুষবর
কোরাণে তোমার ঘোষিত মহিমা, হতে পয়গম্বর।’
সঙ্গে সঙ্গে মুসলিম সমাজে লোষ্ট্রপাত, প্রতিবাদ গর্জে ওঠে চারদিকে। মোসলেম জগৎ পত্রিকার ১৫ জুলাই, ১৯২৫ সংখ্যার সম্পাদকীয়তে তীব্র ভাষায় লেখা হয়… “ইসলাম ধর্মের প্রতি তাঁহার যথেচ্ছায় লেখনী সঞ্চালনকে ঘৃণা না করিয়া পারি না।……একী স্বেচ্ছাচারিতা! নজরুল! তোমায় জিজ্ঞাসা করি, কোন্ সাহসে তুমি এহেন অগৌরবে আল্লার নবীর উপর বাণী প্রয়োগ করিয়াছ?… নজরুল! তোমার লেখনীকে অভিসম্পাৎ, তোমার কবি প্রতিভাকে শত সহস্র ধিক্কার।”
মোসলেম দর্পনের অগস্ট, ১৯২৫ সংখ্যায় ‘ইসলাম বৈরী মুসলমান কবি’ নামে এক প্রবন্ধে নজরুলকে তীব্র তিরস্কার করে লেখা হয়– “ইহাতে তিনি যে গুরুতর স্বেচ্ছাচারিতা, ধর্মজ্ঞানহীনতা ও বিবেক শূন্যতার পরিচয় দিয়াছেন, তাহাতে মুসলমান মাত্রই ব্যথিত না হইয়া থাকিতে পারে না।… -কবি নজরুল সমগ্র মুসলমান সমাজের নিকট অপরাধী। যাহাতে ভবিষ্যতে – তিনি সংযমী হইয়া লেখনী ধারণ করেন তজ্জন্য তাঁহাকে এক্ষণে যথোচিত শাসন করা সমাজের পক্ষে একটা কর্তব্য হইয়া পড়িয়াছে।… যদি তিনি এখন হইতে সতর্কতা অবলম্বন না করেন বরং পূর্ববৎ লেখনী পরিচালনা করিতে থাকেন তাহা হইলে বিচারালয়ে আইনের সাহায্যেও তাঁহাকে শাসিত করিতে হইবে।”
এ-জাতীয় শাসানি তাঁকে বহু বারই সহ্য করতে হয়েছে তবু তিনি নিজের কর্তব্য থেকে এক পা-ও সরে দাঁড়াননি। তিনি এ-যুগের বিপ্লবী লেখক হলে তাঁর ভাগ্যে কী জুটত কে জানে, তাঁকেও তসলিমা নাসরিন কিংবা সলমন রুশদির মতো লুকিয়ে জীবন-যাপন করতে হত কিনা, বলা যায় না। চেষ্টা করে নয়, স্বভাব সিদ্ধ বিশ্বাসেই তিনি সকল ধর্মকে সমান উচ্চাসনে বসাতে চেয়েছিলেন। আবার অন্য দিকে প্রতিটি ধর্মের অন্ধকার দিক নিয়ে তিনি সমালোচনা করতেও কুণ্ঠা বোধ করতেন না। তাঁর কাছে হজরত কিংবা চৈতন্যের মধ্যে কোনও প্রভেদ ছিল না। বিধর্মী হয়েও তিনি তাই বাঙালি হিন্দুর আরাধ্য দেবী কালীকে ধিক্কার দিয়ে লিখতে পারেন–
আর কত কাল থাকবি বেটী, মাটির ঢেলার মূর্তি আড়াল,
স্বর্গ যে আজ জয় করেছে অত্যাচারী শক্তি চাঁড়াল।……
অনেক পাঁঠা মোষ খেয়েছিস রাক্ষসী তোর যায়নি ক্ষুধা;
আয় পাষাণী, এবার নিবি আপন ছেলের রক্ত সুধা।
আবার ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে তৎকালিক সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার জন্য, তাঁর ধারণা অনুযায়ী তিনি পণ্ডিত মদনমোহন মোহন মালব্য এবং স্বামী শ্রদ্ধানন্দকে দায়ী করে এক বক্তৃতা দেন চট্টগ্রামে। যে মুসলমান সমাজ তাঁকে এত কাল ইসলাম বিরোধী বলে রক্ত-চক্ষু দেখাতেন, তাঁরাই তাঁর ওই ভাষণে উৎফুল্ল হয়ে লেখেন– ১৬ “… কবির এই সাচ্চা কথা শুনিয়া, ও ঘরের ছেলে আবার ঘরে ফিরিয়া আসিতেছেন মনে করিয়া কতকগুলি হিন্দু বন্ধুর চোখ-টাটানি শুরু হইয়া গিয়াছে।…. স্বাগতম। হে কবিবর! এস এস!! অতঃপর আমরা কবিবরের ব্যোম ভোলানাথ শিব-শংকরের পরিবর্তে আল্লা হো আকবর ধ্বনি শুনিবার আকাঙক্ষা রাখি।”
নজরুল নিশ্চয়ই ওই সম্পাদকীয় পড়ে মনে মনে খুব হেসেছেন। কেন-না সাম্প্রদায়িক মনোভাব সম্পন্ন মানুষের বিচার-বুদ্ধির হালহকিকত তিনি ভালভাবেই জানতেন। তাঁদের কাছে তখনই দিন, তো পরক্ষণেই রাত। দৃষ্টান্তের অভাব নেই। ওই ঘটনার বছর তিনেক পরের বিবরণ দিতে গিয়ে সওগাত পত্রিকার সম্পাদক তাঁর স্মৃতি চারণায় লেখেন– “তাঁরা নজরুল সংবর্ধনা সভার আয়োজন করেছিলেন ১৫ ডিসেম্বর, ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে। তার আগে অভ্যর্থনা-কমিটি গঠনের জন্য আহূত সভায় মোহম্মদী পত্রিকার সম্পাদক, সমাজ বিরোধী গুণ্ডাদের দলবল নিয়ে আগে-ভাগেই সভায় উপস্থিত থাকেন এবং ইসলাম বিরোধী কবি নজরুলকে কোনও মতেই যেন সংবর্ধনা না-দেওয়া হয় তার জন্য চিৎকার চেঁচামিচি শুরু করেন। কার্যত মোহম্মদীর সম্পাদক সওগাতের সম্পাদককে দৈহিক আক্রমণ করার জন্যও সেদিন প্রস্তুত হয়েই এসেছিলেন।”১৭ ক্রমে সভায় আহূত ভদ্রজনেরা আসতে থাকেন এবং তাঁরা ব্যাপারটি অনুধাবন করে দুর্বৃত্তদের সভা-স্থল থেকে তাড়িয়ে দেন। ১৯২৮ সেপ্টেম্বর, শ্রীহট্টের সংবর্ধনা সভাতেও নজরুল-বিরোধীরা ও-রকমেরই একটি কাণ্ড করেছিলেন। নজরুল সওগাতের পক্ষ থেকে সংবর্ধনা ও তা নিয়ে সম্ভাব্য বিরোধিতার ব্যাপারটি বোধ হয় আগে-ভাগেই আশঙ্কা করেছিলেন তাই তাঁর সংবর্ধনা অনুষ্ঠান হওয়ার পূর্বেই তিনি একটি কবিতা লেখেন, তার সারমর্ম তাঁর ভাষাতেই বলা যায়–
অসুন্দরের প্রতীক উহারা ফুল ছেঁড়া শুধু জানে
আগে যে চলিবে উহারা টানিবে কেবলি পিছন পানে।
অসম সাহসে আমরা অসীম সম্ভাবনার পথে
ছুটিয়া চলেছি সময় কোথায় পিছে যাব কোন মতে!
নীচের যাহারা রহিবে নীচেই উর্ধ্বে ছিটাবে কালি,
আপনার অনুরাগে চলে যাব আমরা মশাল জ্বালি।
বলা বাহুল্য নজরুলের ওই কবিতা আজও সমান ভাবে প্রযোজ্য। যুগ বদলেছে, মন বদলায়নি। আবরণ শক্ত হয়েছে, তবে ভঙ্গুর; স্বার্থাঘাতেই ফেটে চৌচির।
নজরুলের অর্থনৈতিক সংকটের কথা সর্বজন বিদিত। হঠাৎ প্রয়োজন হলে তিনি প্রকাশকের কাছে যেতেন, টাকা চাইতেন, কখনও কোনও বই কিংবা কবিতা লিখে দেবেন বলে অগ্রিমও কিছু চাইতে বাধ্য হতেন। প্রকাশকেরাও তাঁর অসহায় অবস্থার কথা অনুমান করে তাঁকে প্রতারিত করতেন নানা ভাবে। কখনও অত্যন্ত কম মূল্যে গ্রন্থ-স্বত্ব কিনে নিতেন, কিংবা প্রাপ্যের কিয়দংশ দিয়ে, তাঁকে সেবারকার মতো বাড়ি পাঠিয়ে দিতেন। এখানে তাঁর লেখা কয়েকটি চিঠির অংশ বিশেষ থেকে উল্লিখিত ঘটনার প্রমাণ পাওয়া যায়।
১৯২২ খ্রিস্টাব্দে কুমিল্লার কান্দির পাড় থেকে সম্পাদক আফজল উল হককে লেখেন– “আজই কুড়ি টাকা টেলিগ্রাফ মনিঅর্ডার করে পাঠাবেন কাইন্ডলি, বড্ড বিপদে পড়েছি। টাকা চাই-ই ভাই। নইলে খেতে পাব না।”
বিয়ের পর ১৯২৪ সালে রংপুরের মাহফুজুর রহমানকে লেখেন– “বইয়ের টাকা আদায় হয়ে থাকলে পত্রপাঠ পাঠিয়ে দেবে। বড়ো দরকার পড়েছে টাকার। আদায় না হয়ে থাকলে আদায় করবে পত্রপাঠ। বই বিক্রি না হলে ফেরৎ পাঠাবে- বইয়ের বড়ো দরকার।”
প্রকাশক ব্রজবিহারী বর্মনকে– “যেমন করে পারো পঁচিশটি টাকা আজই টেলিগ্রাফ মনি-অর্ডার করে পাঠাও। তুমি তো সব জানো…” ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দের ৯ অক্টোবর– “আজও আমি শষ্যাগত। বড় যন্ত্রণা পাচ্ছি রোগের ও অন্যান্য চিন্তার জ্বালায়। চিন্তার মধ্যে অর্থ চিন্তাটাই সব চেয়ে বড়। কী করে যে দিন যাচ্ছে….. তোমার প্রেরিত পনর টাকা পেয়েছি। পঁচিশ টাকা চেয়েছিলাম।” আবার অন্য চিঠিতে দেখা যায়– “ঘরে সব মরছে না খেয়ে-তাই এসেছিলাম টাকার যোগাড়ে। তুমি অন্তত পঁচিশ টাকা নিয়ে আসবে।.. এখনও জ্বর ছাড়েনি।”
কিংবা তাঁর আরও একটি চিঠি (এপ্রিল, ১৯২৭)– “বড় বিপদে পড়িয়াছি। গোপালের টাকা পাঠাইবার কথা ছিল। আজও টাকা পাঠাইল না। বাড়িতে একটা পয়সাও নাই।… তুমি পত্রপাঠ মাত্রই অন্তত কুড়ি টাকা টি.এম.ও. করে পাঠাও। নইলে বড় মুশকিলে পড়ব। বাজার খরচের পর্যন্ত পয়সা নেই।” সওগাতের সম্পাদক নাসিরুদ্দিন সাহেবকে লেখা চিঠিতে প্রকাশ পাচ্ছে প্রকাশকেরা তাঁকে কীভাবে বিব্রত করতেন। “…গোপালদা একশো টাকার সব টাকা দেননি। চিঠি লিখে উত্তর পাইনি।…. পাবলিশারের কাছেও টাকা পাচ্ছিনে চিঠি লিখেও, লেখার দামও পাচ্ছিনে- যেখানে যেখানে পাবার কথা।”১৮
প্রকাশকদের প্রতারণার জালে পড়ে নজরুল ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দে মাদ্রাসা এবং মক্তব শিক্ষার্থীদের জন্য ‘মক্তব সাহিত্য’ নামে একটি পাঠ্য পুস্তক রচনা করেন। রচনা করলেই তা স্কুল-পাঠ্য হয় না তাই প্রকাশক, তাঁকে দিয়েই অন্যতম কর্তৃপক্ষ কবি জসিমুদ্দিনের উদ্দেশে একটি সুপারিশ-পত্র লিখিয়ে নেন, পাঠ্যানুমতি হাতে আসে। তখন নজরুলকে দিয়েই প্রকাশকেরা আবার বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কাছে একটি অনুরোধ-পত্রও লিখিয়ে নেন যাতে বইটি বিদ্যালয়ের তালিকা-ভুক্ত হয়। শনিবাবের চিঠি নজরুলের ওই দুর্বলতাকে হাত-ছাড়া করেন না। তৎক্ষণাৎ নজরুলের ধর্ম-নিরপেক্ষতা নিয়ে সংশয় তুলে তাঁদের তরফ থেকে তাঁকে পঞ্চান্ন শতাংশ মুসলিম বলে ধিক্কার জানানো হয়। দুঃখের কথা হল, নজরুল তাঁর অপরিণাম-দর্শিতার জন্য সে-দফা ধিক্কৃত হলেন বটে তবে প্রকাশকদের কাছ থেকে একটা কানাকড়িও তিনি পেলেন না।
সারা জীবন তিনি অর্থ-সঙ্কটে এতটাই ব্যাকুল থাকতেন যে ভালো-মন্দ বিচার করার ক্ষমতাটুকুও বোধ হয় তাঁর ক্রমশ হারিয়ে গেছিল। অত্যন্ত কম দক্ষিণাতেই তিনি তাঁর বই-এর স্বত্ব বিক্রি করে দিতে বাধ্য হতেন। যেমন– “১৯২৬ সালে অভাবের তাড়নায় তিনি নির্ঝর-এর পাণ্ডুলিপি মোহম্মদ কাশেমকে বিক্রি করেন। কাশেম আবার বেশি লাভের আশায় ওই পাণ্ডুলিপি বিক্রি করেন মহসীন এণ্ড কম্পানিকে। তাঁদের প্রকাশনায় পুস্তকটি প্রকাশিত হয় ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দে। কিন্তু নজরুল যেহেতু পাণ্ডুলিপি আগেই বিক্রি করে দিয়েছেন তাই রয়্যাল্টির টাকা তাঁর কাছে আর আসে না।”
অভাবের তাড়নায় গান নিয়েও তিনি তাঁর স্বভাব বিরুদ্ধ উঞ্ছবৃত্তি করতে বাধ্য হন। সে-রকমের প্রচুর উদাহরণ আছে। কৃষ্ণনগর থেকে ২৬ ডিসেম্বর, ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে মুরলীধর বসুকে লেখা তাঁর একটি মর্মস্পর্শী চিঠির উল্লেখ এখানে করা যায়।১৯ কার্যত তিনি সে-চিঠিতে প্রায় ভিখারীর মতো ভাষা ব্যবহার করেছেন অনন্যোপায় হয়ে। এক সময় অসুস্থ শরীরেও টাকার বিনিময়ে তিনি সভা-সমিতিতে যোগদান করার প্রতিশ্রুতি দিতেন। ১৯৪১ ফেব্রুয়ারি বনগাঁর মহকুমা ম্যাজিস্ট্রেট মীজানুর রহমান বনগাঁ সাহিত্য সভার চতুর্থ বার্ষিক সম্মেলনে সভাপতির পদ অলংকৃত করার জন্য নজরুলকে আহ্বান জানান এবং প্রতিশ্রুতি দেন কিছু অর্থ সাহায্যও তিনি করবেন। সে প্রসঙ্গে নজরুলের সম্মতি-জ্ঞাপক চিঠিটির ভাষা ভিক্ষে-চাওয়ার চেয়ে কোনও অংশে কম নয় (অরুণকুমার বোস পৃ ৪৭০-৭৩)। ঘটনা হল, মীজানুর রহমান তাঁকে একটি পয়সাও সে-বার দেন না, চেয়ে নিতেও তাঁর আত্ম-মর্যাদায় বাধে। এক বছর বাদে অন্য কোনও সভায় নজরুলের সঙ্গী সুফি জুলফিকর হায়দর, মীজানুরকে দেখতে পেয়ে চেপে ধরেন এবং অতিকষ্টে প্রতিশ্রুত আড়াই-শো টাকা তাঁর কাছ থেকে আদায় করেন।
তাঁর জীবনে অর্থ-কষ্ট প্রায় অসহনীয় অবস্থায় পৌঁছয়। তবু যখন হাতে কিছুটা পয়সা আসে, তিনি একটু সুখের মুখ দেখেন, তখনই এক-একটা এমন কাণ্ড করে বসেন যে পয়সা হুড়হুড় করে বেরিয়ে যায়। যেমন ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ তিনি ক্রাইসলার মডেলের একটি এলাহি গাড়ি কিনে বসেন। তখনই তাঁকে ‘অগ্নিবীণা’র স্বত্ব বেচে দিতে হয় গোপালদাস মজুমদারের এক বন্ধু-পত্নীর কাছে। প্রমীলার চিকিৎসার ব্যয়-নির্বাহের সুরঙ্গ-পথ দিয়ে সে-গাড়ি অচিরেই অন্তর্হিত হয়। হঠাৎ তাঁর খেয়াল হয়, ভোটে দাঁড়াতে হবে। পরাধীন দেশ। বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভার প্রতিনিধি পদে তিনি দাঁড়ান, ডাঃ বিধান রায় ব্যয় নির্বাহের জন্য কিছু অর্থ দেন বটে তবে বাকি খরচ ঋণ করেই তাঁকে চালাতে হয়। ভোটের ফল নজরুলের জমানত জব্দ। হাঁটু জল থেকে ঋণ গলা জলে উঠে আসে। আসলে নজরুলের জনপ্রিয়তা যে-সমাজে ছিল ভোট-দাতারা সে-সমাজের লোক ছিলেন না, তাঁরা ছিলেন বিত্তবান। বলা বাহুল্য পারিবারিক সূত্রে বিত্তবান বনেদিয়ানার ঐতিহ্য না-থাকায় নজরুল কোনও দিন সমাজের তথাকথিত উপরের স্তরের বন্ধু হতে পারেননি। স্বভাবতই কথা দিয়েছিলেন ভোট দেবেন, নজরুল তা বিশ্বাসও করেছিলেন, কিন্তু দেননি।
১৯৩১ খ্রিস্টাব্দে অন্যান্য পুস্তকের সঙ্গে তিনি গ্রামোফোন কোম্পানির অধীনে-গাওয়া সমস্ত গানের রয়্যালটি কোলকাতা হাইকোর্টের এটর্নি অসীমকৃষ্ণ দত্তের কাছে চার হাজার টাকায় বন্ধক রাখেন। কাজেই কোম্পানি-প্রদত্ত অর্থ ঠিকানা বদল করে এটর্নির তহবিলে জমা হত, নজরুল একটি কানাকড়িও পেতেন না শুধু খেটেই মরতেন। বেতারের রিহার্সাল রুমের অধিকারক ছিলেন নজরুলের প্রিয়-জন হেমচন্দ্র সোম। ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ হেমচন্দ্রের সঙ্গে নজরুলের সম্পর্কে চির ধরে। হেমচন্দ্র নজরুলের বিরুদ্ধে কর্তৃপক্ষের কান ভারী করে তোলেন। একমাত্র সঙ্গীত-রচয়িতার পদ থেকে নজরুলকে সরিয়ে দেওয়া হয়। অভিযোগ– “কাজী সাহেবের রচনার ধার ক্রমে ভোঁতা হয়ে গেছে, বিশেষত কমার্শিয়াল রচনায়।” ক্ষুরধার-লেখক নজরুলের জীবনে এর চেয়ে বেশি আর কী কলঙ্ক থাকতে পারে। অর্থ কষ্টের তাড়নায় নজরুলকে সে-অপবাদও হাসি-মুখে হজম করতে হয়।
নজরুলের আর্থিক অবস্থার শোচনীয় পরিণতি দেখে সত্যিকারের বন্ধুরা বাজেয়াপ্ত বইগুলির উপর থেকে সরকারি নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে বারবার সরকারের কাছে আবেদন করেন। ইংরেজ সরকারের স্বরাষ্ট্র দপ্তরের বশংবদ মন্ত্রী নাজিমুদ্দীন বাহাদুর ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দের মার্চে ঘোষণা করেন-দেশে গণবিদ্রোহ ও বৈপ্লবিক সংগঠনগুলির রাষ্ট্রবিরোধী কার্যকলাপ অক্ষুণ্ণ আছে অতএব নিষেধাজ্ঞা ওঠানো সম্ভব নয়। এ-হেন ব্রিটিশ সরকার নিজের কাজের বেলায় কিন্তু ওই নজরুলেরই শরণাপন্ন হতেন। ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের ৯ ফেব্রুয়ারি, চিন থেকে মার্শাল চিয়াংকাইশেক ভারত পরিদর্শনে আসেন। তাঁকে সংবর্ধিত করার উদ্দেশ্যে ইংরেজ সরকার ব্রিটিশ রেকর্ড কম্পানির মাধ্যমে নজরুলকে দিয়েই গান লেখান–
চীন ও ভারতে মিলেছি আবার মোরা শতকোটি লোক
চীন ভারতের জয় হোক।
ঐক্যের জয় হোক সাম্যের জয় হোক।……
জমিরুদ্দিন খাঁ ছিলেন গ্রামোফোন কম্পানির এক খ্যাতনামা ট্রেনার ও শিল্পী। তাঁর মৃত্যুর পর কম্পানি নজরুলকে ওই পদে বসান এবং তাঁকে পণ্য উৎপাদনের বিরামহীন যন্ত্রে পরিণত করেন। তাঁরা নজরুলকে জমিরুদ্দিন খাঁনের বিকল্প হিসেবে নজরুলউদ্দিন খাঁ বানাতে চেয়েছিলেন। নজরুল ফরমায়েশি গীতিকার ও ট্রেনার হিসেবে ওই কম্পানির অধীনেই রয়ে যান, চাকরি যে ছেড়ে দেবেন তার উপায় ছিল না, সংসার ভেসে যাবে। এভাবে কম্পানি একদিকে নজরুলকে শোষণ করতে থাকেন আর অন্য দিকে নজরুলের মৌলিক প্রতিভা কর্তৃপক্ষের ফরমায়েশ পালন করতে করতে ক্রমশ ভোঁতা হতে থাকে। আবার বেতারও তাঁকে ছেড়ে কথা বলে না, সেখানেও নজরুলকে যন্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়। যে নজরুল বেতারে যোগদান করার পর লেখেন–
আকাশে আজ ছড়িয়ে দিলাম প্রিয়
আমার কথার ফুল গো,
আমার গানের মালা গো-
কুড়িয়ে তুমি নিও।……
ছড়ানো সে-ফুল কুড়িয়ে সঞ্চয় করে রাখার তাগিদ কিন্তু কারও ছিল না। বেতার কম্পানি নজরুলের অবদান সংরক্ষণ করেনি। নজরুল ততক্ষণে বিজ্ঞাপনের কেনা-গোলাম হয়ে গেছেন। ম্যালেরিয়া প্রতিরোধের জন্য বিজ্ঞাপনের প্রয়োজন হয়। তিনি ৩০ ডিসেম্বর ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দে কচুরিপানা ধ্বংসের গান লেখেন-
ধ্বংস করো এই কচুরি-পানা
এরা লতা নয় পরদেশি অসুর ছানা।…
চলচ্চিত্রের জগতেও নজরুল-বঞ্চনার দৃষ্টান্ত বড়ো একটা কম নেই। একটি ঘটনার উল্লেখ আগেই করা হয়েছে। অন্যগুলির সারাংশ উল্লেখ করা এখানে অপ্রাসঙ্গিক হবে না। ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দে শৈলজানন্দের পরিচালনায় কালী ফিল্মস্ পাতালপুরী ছবি নির্মাণ করে। শৈলজানন্দের অনুরোধেই নজরুল হলেন সুরকার ও সঙ্গীত পরিচালক। তাঁর ওই পরিশ্রমের বিনিময়ে তাঁকে মাত্র পঞ্চাশটি টাকা ধরিয়ে দেওয়া হয়।
আবার ১৯৪১ এবং ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে নির্মিত শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়ের পরিচালনায় যথাক্রমে নন্দিনী ও চৌরঙ্গী ছায়াছবির সঙ্গীত পরিচালকের ভূমিকা পালন করেন নজরুল। কিন্তু প্রযোজক ফজলি ব্রাদার্স তাঁর পারিশ্রমিক হিসেবে তাঁকে একটি পয়সাও দেন না।
পায়েনিয়ার্স ফিলন্সের নিবেদন ধ্রুব চলচ্চিত্রে নজরুল সঙ্গীত পরিচালক তো ছিলেনই তার উপরে তিনি নারদের চরিত্রে অভিনয়ও করেন। পারিশ্রমিক বাবদ তাঁকে সর্বমোট দেওয়া হয় মাত্র পাঁচ-শো টাকা। বলা বাহুল্য সিনেমায় অভিনয়, সঙ্গীত রচনা, সুরকার, গায়ক ও সঙ্গীত পরিচালকের ভূমিকা একাদিক্রমে পালন করে নজরুল সে-যুগের প্রেক্ষাপটেও যা পেয়েছেন তা আর বলবার মতো কোনও কথা নয়। বঞ্চনা বই একে আর কী বলা যেতে পারে! সকলে যেন শলা-পরামর্শ করে তাঁকে সব দিকে থেকে বঞ্চিত করেছেন।
১৯৪২ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় নজরুলকে স্নাতক পরীক্ষার পরীক্ষক নিযুক্ত করে। নিয়ম-কানুনের ব্যাপারে সাহায্য করেন একদা নবযুগ পত্রিকায় নজরুলের সহকর্মী কালীপদ গুহ। কাজ সুষ্ঠু-ভাবেই সম্পন্ন হয় কিন্তু নজরুল তার বিনিময়ে একটি পয়সাও পান না, কৌশলে সে-পয়সা আত্মসাৎ করেন কালীপদ গুহ স্বয়ং। ওই নবযুগ পত্রিকাতেই মাসিক সাড়ে তিন-শো টাকা বেতনে সম্পাদক হিসেবে কাজ করতেন নজরুল। নজরুল জীবনীকারেরা উল্লেখ করেছেন– “নজরুল সেখান থেকেও কোনও পয়সা শেষাবধি পাননি।”
রেডিও, গ্রামোফোন, সিনেমা ইত্যাদি ব্যাপারে নজরুল ছিলেন এক জন স্বনামধন্য ব্যক্তি। কবি ও লেখক তো বটেই। তাঁর বহুমুখী প্রতিভার সুবাদে বহু মহিলার সঙ্গে তাঁর পরিচয় ও অন্তরঙ্গতা গড়ে ওঠে। এটাই স্বাভাবিক। তাঁদের মধ্যে কেউ ছিলেন কবি, কেউ সম্ভ্রান্ত ঘরের মহিলা আবার কেউ পেশাদার শিল্পী। কবি তাঁদের অনেকের কাছ থেকেই নানা ভাবে আঘাত পেয়েছেন এমনকী পাড়ার মস্তানদের দ্বারা শারীরিক ভাবে নির্যাতিত হতেও তাঁর বাকি ছিল না। বিস্তারিত বিবরণ অন্যত্র আছে।৫ তবে সব চেয়ে বেশি রকমের আঘাত যে-মহিলার কাছ থেকে তিনি পেয়েছিলেন, তিনি ছিলেন উচ্চ শিক্ষিতা। ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে যৌবনের এক বিশেষ দুর্বল মুহূর্তে তাঁর আগমন। কবি বেশ কিছু কাল তাঁর চিন্তাতেই আনমনা থাকতেন। এ-খবর কোনও না কোনও ভাবে কৃষ্ণনগরের বাড়িতে এসে পৌঁছয়। খবর জেনে প্রমীলাসহ সংসারের আর সকলে কবির সঙ্গে কেমন আচরণ করতেন তার আভাস মোতাহর হোসেনকে লেখা নজরুলের ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দের ৩১ শে মের একটি চিঠিতে কিয়দংশ পাওয়া যায়।… “তুমি ভাবতে পার বন্ধু, একটি অন্ধকার ঘরে দুজন দুজনের দিকে পিঠ ফিরিয়ে বসে কাঁদছে!…”
কবি নিজে অর্থ-সংকটে বেসামাল থাকলেও চুরুলিয়ায় তাঁর ভায়েদের জন্য উদ্বেগ তাঁর থাকতই, তাঁদের তিনি কোনও দিন ফেলে দিতে পারেননি। তার প্রমাণ পাওয়া যায় ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দে ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্ট কাজি কায়েম হোসেনকে লেখা এক চিঠিতে….. “আপনি তাদের উপর যথেষ্ট দয়া এবং সহানুভূতি দেখিয়ে থাকেন। আমার নসিব খারাপ। আমি তাদের কোনো সাহায্য করতে পারি না, বরং তাদের যথেষ্ট কষ্ট দিয়েছি। আমার নিজেকেও (আর্থিক) সাহায্য করার ক্ষমতা আমার নেই।…. আমার বড়ো ভাই কোনো এক রোগে ভুগছেন।… আপনি কি মেহেরবানি করে আপনার রোগী হিসেবে তার সকল দায়িত্ব গ্রহণ করতে পারেন? আপনি সরাসরি অথবা আমার ভ্রাতার মাধ্যমে আপনার ওষুধ পত্রাদির বিল পাঠিয়ে দেবেন। যদিও আমি একজন গরিব, তবু আপনার টাকা আমি অবিলম্বে পাঠিয়ে দেব… আমি আমার ভ্রাতাদের সাথে আপনার আশ্রয় ভিক্ষা করছি…”
১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে ৭ মে বুলবুলের মৃত্যুর পর থেকে নজরুল পর-জন্ম এবং অলৌকিকতা ইত্যাদি আধিভৌতিক ব্যাপারে বিশ্বাস রাখতে শুরু করেন। বুলবুলের মৃত্যুতে নজরুল চরম আঘাত পান। তার উপরে বুলবুলের মৃত্যু হয় বসন্ত রোগে। সে-সময়ে বসন্ত, এক দুরারোগ্য সংক্রামক ব্যাধি হিসেবে পরিগণিত হত এবং মানুষের মধ্যে আতঙ্কের সৃষ্টি করত। কাজেই শব-বহনের জন্য লোক জোগাড় করা, কবরের জায়গার ব্যবস্থা করা ইত্যাদি ব্যাপারে যথাসময়ে তথাকথিত সুহৃদদের সাহায্য পাওয়া যায় না, শোকাহত কবিকে একাই সব দিক সামাল দিতে হয়। কবি তখন থেকেই বড়ো অসহায় হয়ে পড়েন, মনের জোরটাও তাঁর ক্রমাগত ম্রিয়মাণ হতে থাকে।
বুলবুলের মৃত্যুতে নজরুলের মনে যে দৈব-বিশ্বাসের সংক্রমণ ঘটেছিল সে-বিশ্বাস ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দে প্রমীলার পক্ষাঘাতের সূচনায় তীব্র-ভাবে বিস্তার লাভ করে। তিনি সম্পূর্ণ-রূপে অসহায় বোধ করতে থাকেন আর ওই দুর্বল মুহূর্তে লালগোলা হাই স্কুলের হেডমাস্টার বরদাচরণ মজুমদার নামে এক যোগীবর নজরুলের যুক্তিবাদী মনকে কুক্ষিগত করে ফেলেন। কথিত আছে, নজরুল সে-সময় সাধন-ভজন নিয়ে পাগলের মতো জীবন যাপন করতে থাকেন এবং তাঁর বিশ্বাস হয়, সাধনায় তিনি সফল হবেনই, মৃত বুলবুলের সঙ্গে তাঁর দেখা হবে এবং প্রমীলা পক্ষাঘাত মুক্ত হবেন। অনেকে বরদাচরণ মজুমদারের বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলেন যে তিনি তাঁর লেখা ‘পথহারার পথ’ পুস্তকের ভূমিকা লিখিয়ে নেওয়া ছাড়াও কার্যত নজরুলকে নানা ভাবে শোষণ করতে থাকেন। তাঁকে লেখা নজরুলের চিঠিতে তাঁর প্রতি পূর্ণ-নির্ভরতার ইঙ্গিত আছে। কার্যত বিদ্রোহী তথা যুক্তিবাদী নজরুলের সে-সময়ই মানসিক মৃত্যু হয় বলে ধরে নেওয়া যায়। কেন-না ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন ওই তুকতাকের উপর বিশ্বাস বশতই তিনি আনমনা হয়ে গৃহত্যাগ করেন এবং পরে পুলিশের সাহায্যে কামারহাটি হাসপাতাল থেকে তাঁকে বাড়িতে ফিরিয়ে আনা হয়। অর্থাৎ তিনি তখনই উন্মাদ-প্রায়। মস্তিষ্কের ক্রম-বর্ধমান রোগের জন্য ওই উপসর্গ নাকি ওই তান্ত্রিক আচার-আচরণের পরিণতিতে তাঁর ওই রোগ, বলা কঠিন। বড়ো দুর্ভাগ্যের কথা। ঝাড়ফুঁক, তন্ত্র-সাধনা, কালী-সাধনা, দেবতার কাছে ধর্না, ভূত-সিদ্ধি, বেতাল সিদ্ধি কিংবা তুকতাকে তাঁর পারিবারিক কিংবা মানসিক যন্ত্রণার কোনও উপশম হয় না, বরং তিনি ক্রমশ মানসিক ভারসাম্য হারাতে থাকেন, এ-সিদ্ধান্ত অ-বিতর্কিত।
শেষের কথা। কবি ক্রমশ নীরব হয়ে যাচ্ছেন। সূত্রপাত ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের ৯ জুলাই বেতার-কেন্দ্রে। তারপর সরকারি, বেসরকারি, পত্র-পত্রিকা, ছাত্র-সমাজ আদি বিবিধ সংস্থার তরফ থেকে তাঁর চিকিৎসার জন্য অর্থ সাহায্য আসতে থাকে। বিস্তারিত ইতিহাস এখানে লেখার নয়। তবে অসুস্থ কবিকে নিয়ে তখনও যে প্রতারণার খেলা জমে উঠেছিল তার কয়েকটির উল্লেখ এখানে প্রাসঙ্গিক হবে। সুফি জুলফিকর হায়দরের বই থেকে কিয়দংশ– “…এই সময়টায় কবির আর্থিক দুরবস্থা আরও চরমে উঠেছিল; আর তারই সুযোগ নিয়ে কলকাতা শহরে, এবং মফঃস্বল অঞ্চলেও টাকা রোজগারের ফিকির হিসাবে একে অন্যের সাথে যেন প্রতিযোগিতা শুরু করে দিয়েছিল। নানা ধরনের ভুয়া ফান্ড, সমিতি কত যে রাতারাতি গড়ে উঠতে লাগল-এমনকী কবির নামে লটারি খেলা পর্যন্ত শুরু হয়ে গেল। এ সমস্ত ভণ্ডের দল আসলে আত্ম-স্বার্থের জন্যই এই ঘৃণ্য কাজে মেতেছিল, কবির জন্য নয়।”
সওগাত পত্রিকার জানুয়ারি, ১৯৪৬ সংখ্যায় প্রকাশিত একটি খবরে প্রকাশ পায়– “বাংলা প্রাদেশিক সরকার ১৯৪৪ আগস্ট থেকে নজরুলকে মাসিক ২০০ টাকা প্রদানের যে প্রস্তাব মঞ্জুর করেছিলেন তা ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দের আগস্ট থেকে হঠাৎ বন্ধ করে দেওয়া হয়।”
১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি নাগাদ ডাঃ শ্যামাপ্রসাদের উদ্যোগে একটি সাহায্য কমিটি গড়ে ওঠে এবং টানা পাঁচ মাস সেখান থেকে মাসিক দু’শো টাকা করে অর্থ সাহায্য পাঠানো হতে থাকে। ষষ্ঠ মাস থেকে কমিটি সাহায্য বন্ধ করে দেয় এই অজুহাতে যে “পরিবারটির সাহায্যের আর কোনও প্রয়োজনই নেই। এই অতিরিক্ত অর্থের দ্বারা তাদের বিলাস-ব্যসন, অতিথি আপ্যায়ন, খানাপিনা এই সব চলে। সকাল বিকাল এমন পরিবারের মিঠাই-মণ্ডা, চা-সন্দেশ জোগানোর জন্য কমিটি আর লোকের কাছে হাত পাততে পারবে না।” কী নির্মম সিদ্ধান্ত। অর্থাৎ অসুস্থ কবিকে নিয়েও মানুষ যেন প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার কাজে উঠে-পড়ে লাগেন।
সে-প্রসঙ্গে নজরুলের শাশুড়ির গৃহত্যাগের সম্ভাব্য কারণটির উল্লেখও বোধ হয় অপ্রাসঙ্গিক হবে না। ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের অগস্ট মাসে উন্মাদ জামাতা, পক্ষাঘাত-গ্রস্ত কন্যা এবং দুই নাবালক নাতিকে ত্যাগ করে শ্যামবাজারের গৃহ থেকে নজরুলের শাশুড়ি গিরিবালা দেবী নিরুদ্দেশ হয়ে যান। জসিমুদ্দিন তাঁর লেখা ‘ঠাকুরবাড়ির আঙ্গিনায়’ গ্রন্থে গিরিবালা দেবীর বক্তব্যের কিছুটা অংশ তুলে ধরেন।….. “জসীম, তোমরা জানো লোকে আমার নিন্দা করে বেড়াচ্ছে। নুরুর নামে যখন থেকে যত টাকা পয়সা আসে আমি নাকি সব বাক্সে বন্ধ করে রাখি। নুরুকে ভালোমতো খাওয়াই না, তার চিকিৎসার ব্যবস্থাও করি না।….. আমি তোমায় বলে দিলাম জসীম, এই সংসার থেকে একদিন আমি কোথায় চলে যাব। এই নিন্দা আর আমি সহ্য করতে পারছি না।” বলা বাহুল্য নজরুল এ-সব কিছুই জানতে পারলেন না। তিনি তখন বাকশক্তি-হীন এক শিশু মাত্র। অথচ নিন্দুকেরা অসুস্থ নজরুলের এক মাত্র সহায়-সম্বল মাতৃ-স্বরূপা শাশুড়ি গিরিবালা দেবীকেও গৃহত্যাগ করাতে ছাড়েননি।
নজরুল এক জন সাহিত্যিক ছিলেন, কোনও পক্ষই তাতে আপত্তি করবেন না। বহু সাহিত্যিকই অর্থ-কষ্টে ভুগেছেন, সে-অর্থে নজরুল কোনও ব্যতিক্রম নন সত্যই। কিন্তু সারা জীবন ধরে নজরুলের মতো ঘরে-বাইরে নির্যাতন আর বঞ্চনা, বোধ হয় কাউকেই সহ্য করতে হয়নি। সেখানে তিনি ছিলেন ব্যতিক্রম। আসলে নজরুলের হৃদয় ছিল আকাশের মতো প্রশস্ত; নদীর স্রোতের মতো ছিল তাঁর প্রাণ-উচ্ছল জীবনী-শক্তি, শিশুর মতো কোমল ছিল তাঁর মন। আচরণে তিনি ছিলেন ব্যোম ভোলানাথ, শুচিতার প্রতীক। মানুষের প্রতি বিশ্বাস ছিল তাঁর অপরিসীম, অবিশ্বাস করতে তিনি শেখেননি কোনও দিন। তাই, যে যে-ভাবে পেরেছেন, তাঁকে প্রতারিত করেছেন; আঘাত হেনেছেন নির্দয়, নির্যাতন করেছেন নির্মম আর তাঁর প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত করেছেন নির্ভয়ে। আবার জন্ম-সূত্রে কবি ছিলেন মুসলমান কিন্তু আচারে ছিলেন সর্ব-ধর্ম সমন্বয়ের অগ্রদূত, সাম্যবাদী, গরিবের বন্ধু, স্বাধীনতাকামী এক জন নির্ভীক সৈনিক। তথাকথিত স্ব-ধর্মী মুসলিমেরা তাঁকে যেমন ছেড়ে কথা বলেননি, প্রকাশ্যে প্রতিবাদে-নিন্দায় তাঁর জীবন অতিষ্ঠ করে তুলেছেন, তেমনই, হিন্দুরা প্রকাশ্যে কিছু না-বললেও মনে-প্রাণে তাঁকে সহ্য করেননি, ঠেলে সরিয়ে রেখেছেন দূরে। কবি চিরটাকাল তাই করাতের তীক্ষ্ণ প্রান্তেই পড়ে থাকলেন, নীরবে হলেন রক্তাক্ত।
আর ঈর্ষাকাতর সাহিত্যিক বন্ধুদের তো কথাই নেই। তাঁরা কারণে-অকারণে তাঁকে করেছেন লাঞ্ছিত-অপমানিত। তাই বুঝি চরম অভিমানে মুখর কবি একদিন নীরব হয়ে গেলেন। তাঁর মৃত্যু হল। মরণের পারেও কবি শান্তি পেলেন না। কবি ভেবেছিলেন আর কবি-পত্নী প্রকাশ্যে বলেছিলেন, মৃত্যুর পর দুজনকেই যেন শুইয়ে দেওয়া হয় জন্ম-ভূমি চুরুলিয়ায়। কার্যত নিস্পন্দ-নিঃসঙ্গ কবির দেহ পড়ে রইল ঢাকায় আর কবি-পত্নী প্রমীলা প্রতীক্ষায় রইলেন চুরুলিয়ায়। দুজন দু-রাষ্ট্রে। মরণের পারেও কবি বঞ্চিত রইলেন, পত্নীকে পাশে পেলেন না। বড়োই নির্মম এই পরিহাস।
কৃতজ্ঞতা স্বীকার : নজরুল বিষয়ক প্রচুর বই-পত্র কবি মতিউল্লাহ আমাদের ব্যবহার করতে দিয়েছেন। আমরা কৃতজ্ঞ।
তথ্যপঞ্জি :
১। রাজশক্তি ও ধূমকেতুর কবি: উদয়ন মিত্র পৃ ২৩ এবং নজরুল জীবনী : অরুণ কুমার বসু পৃ ৩,৫,১৩ ও ১৪।
২। Report of the Public Instruction in Bengal (chapter X) for 1917-18
৩। প্রেমিক নজরুল : দীপ্র কলম, অক্টোবর, ২০০৫ : রাজশক্তি ও ধূমকেতুর কবি : উদয়ন মিত্র পৃ ২৫-২৬
৪। নজরুল জীবনী : অরুণ কুমার বসু পৃ ২৯ : এই প্রবন্ধে অরুণ বসুর বইটিকে আকর গ্রন্থ হিসাবে ব্যবহার করা হয়েছে এবং অ-থেকে যথেচ্ছ তথ্য প্রয়োগ করা হয়েছে যত্র-তত্র।
৫। প্রেমিক নজরুল : দীপ্রকলম, অক্টোবর, ২০০৫
৬। পত্র সাহিত্যে পত্রহীনতা : নজরুল পত্রালোক : আবদুল আজিজ আল আমন : কাফেলা, অক্টোবর, ১৯৮১
৭। ২৯ ফেব্রুয়ারি, ১৯২৪ ‘ছোলতান’ পত্রিকায় নজরুল সম্পর্কে লেখা হয়… “তাঁহার এই কবিতায় (বিদ্রোহী) দু-একটা মোছলমানী শব্দ থাকিলেও উহার ভিতরে সব জিনিসটা হিন্দু মতে, বলিতে গেলে উহার কাঠামো হইতে আরম্ভ করিয়া বাহিরের সাজসজ্জা পর্যন্ত সবই, হিন্দু ধর্মের আদর্শে অনুপ্রাণিত।… বাংলার মোছলমান সমাজে তাঁহার মতো কোনও কবি জন্মাই নাই বলিয়াই তাঁহার এই চিত্ত বিপর্যয় আমাদের বিশেষ দুঃখের কারণ হইয়াছে।… আমাদের এই বিদ্রোহী কবি, দেশাত্মবোধের একটা ভুল ধারণার বশবর্তী হইয়া এছলামকে পর্যন্ত বিপন্ন করিতে চাহেন। কিন্তু কবি ভুলিয়া গিয়াছেন যে, এছলাম কোথাও দেশ প্রেমের পরিপন্থী হইয়া দাঁড়ায় নাই।”
৮। প্রবাসী পত্রিকা কর্তৃপক্ষ নজরুলকে নানা ভাবে বিব্রত করতে কুণ্ঠা-বোধ করেননি। এমনকী তাঁর কাব্যকেও আস্তাকুড়ে নিক্ষেপ করতে তাঁদের কোনও দ্বিধা হয়নি। সর্বহারা কাব্য গ্রন্থ প্রকাশিত হল, প্রবাসী লিখল…. “ভগবান পাখীকে একটি মাত্র সুর দিয়াছেন।… নজরুল ইসলাম সাহেবও বিহঙ্গের সমতুল্য। তাঁহারও একঘেয়ে হইবার ভয় নাই।….. কাজি সাহেব শিশুর মত বেলোয়ারি জিনিষ ভাঙিয়া ভাবেন যে ভূমিকম্পের সৃষ্টি করিলাম।….. কিন্তু নজরুল সাহেব সংক্রান্ত সব ব্যাপারই এক একটা দুর্বোধ্য হেঁয়ালি।…. তাঁহাকে যে তাঁহার ভক্তবৃন্দ নবযুগরবি বলিয়া থাকে তাহাও একটা হেঁয়ালি। সব চেয়ে বড় হেঁয়ালি এইটা, কি দেখিয়া বাংলা দেশের সাহিত্যিক ও সাহিত্য রসিক সম্প্রদায় বিনা বাক্য ব্যয়ে এই অসম্বন্ধ প্রলাপভাষীকে কবি বলিয়া মানিয়া লইয়াছে।”
শনিবারের চিঠিতে সজনীকান্ত দাস লিখলেন প্যারোডি এবং মোহিতলাল মজুমদার, প্রবন্ধের মাধ্যমে নজরুলকে এক হাত দেখে নিলেন। তাতেও সন্তুষ্ট না-হয়ে অভিযোগ গেল রবীন্দ্র-দরবারে।
৯। নজরুল জীবনী : অরুণ কুমার বসু পৃ ১৩০-১৩১ : তার উপরে প্রমীলার বয়স তখন মাত্র ষোল এবং নজরুলের পঁচিশ। মুসলিম মতে অ-প্রাপ্ত বয়স্কার বিয়ে হতে পারে কিন্তু নজরুল চাইছিলেন না প্রমীলা ধর্মান্তরিত হোক। শেষ পর্যন্ত ইসলামের এক লোকায়ত মত আহলুল কেতাব বিবাহ-বিধি মেনে নজরুল-প্রমীলার বিয়ে হয়, প্রমীলার স্ব-ধর্মও রক্ষা পায়। সহযোগিতা করেন, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ, ভূপতি মজুমদার এবং মিসেস এম. রহমান।
১০। কাফেলা: রফিকুল্লাহ : ১৩৮৮ আষাঢ় এবং অরুণ বসু পৃ.১৩১,১৩৩, ১৩৯, ১৪০
১১। নিষিদ্ধ নজরুলঃ শিশির কর : পৃ ১০-১১ : “… It (Yugabani) breathes bitter racial hatered directed mainly against the British, preaches revolt against the existing admin-istration in the country and abuses in the very strong language the ‘slave-minded’ Indians who uphold the adminstration…… On the whole it is a dangerous book, forceful and vindictive.”
১২। রাজশক্তি ও ধূমকেতুর কবি : উদয়ন মিত্র : পৃ৮৭
যুগবাণী নিষিদ্ধ হয় ২৩। ১১। ১৯২২
বিষের বাঁশি নিষিদ্ধ হয় ২২।১০।১৯২৪
ভাঙার গান নিষিদ্ধ হয় ১১।১১।১৯২৪
প্রলয় শিখা নিষিদ্ধ হয় ১৭/০৯/১৯৩০
চন্দ্রবিন্দু নিষিদ্ধ হয় ১৪।১০।১৯৩১
১৩। নিষিদ্ধ নজরুল : শিশির কর : পৃ ৩১ : ১৯৩০ সালের ৬ সেপ্টেম্বরের চিঠিতে কোলকাতা পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের ডেপুটি কমিশনারকে তিনি জানান- I have carefully gone through the book Pralay Sikha by Nazrul Islam, which has recently come out of Press. There are several passage in it which came under the mischief of section 153(A) and 124(A) of the Indian Penal Code. In the present case I would advise the immediate proscription of the book under section 99(A) of the Criminal Procedure Code…..
১৪। নিষিদ্ধ নজরুল : শিশির করঃ পৃ ৩০
১৫। ‘ইন্দ্রপতন’ ছাড়াও ‘সান্ত্বনা’, বিজলি পত্রিকার আষাঢ় সংখ্যায় এবং ‘রাজভিখারী’, কল্লোল পত্রিকার শ্রাবণ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। ওই তিনটি কবিতা প্রকাশের বিরুদ্ধে মুসলিম সমাজ ক্ষেপে ওঠে।
১৬। সাপ্তাহিক মোহাম্মদী সম্পাদকীয় (২৭ অগস্ট, ১৯২৬)
১৭। নজরুলের প্রতি মোহম্মদী পত্রিকা কর্তৃপক্ষের মনোভাব বোঝা যায় ওই পত্রিকায় কার্তিক, ১৩৩৫ সংখ্যায় নাজিব আহমেদ চৌধুরী লিখিত ‘এছলাম ও নজরুল ইসলাম’ প্রবন্ধে। “কবি নজরুল ইসলাম এছলামের এই চরম ও পরম শিক্ষার মূল কাটিতে চাহিয়াছেন- এক দিকে আল্লাহকে অমান্য করিয়া, তাঁহার বুকে পদাঘাত করায় ও হাতুড়ি ঠোকার চরম ধৃষ্টতা প্রকাশ করিয়া, অন্য দিকে কালী, দুর্গা ও সরস্বতী প্রভৃতির পূজা-অর্চনাকে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা পাইয়া। সুতরাং বর্তমান যুগে তিনি যে এছলামের সর্ব প্রধান শত্রু তাহাতে আর বিন্দু মাত্র সন্দেহ নাই।…..”
ওদিকে কিন্তু এক মুসলিম-মা সুফিয়া কামাল নজরুল-নির্যাতনের আশঙ্কায় আতঙ্কিত হয়ে ১৯২৭ এর ৪ জুলাই মহম্মদ নাসিরুদ্দিনকে এক চিঠিতে লেখেন– “কাগজে সেদিন দেখলুম, তাকে ঢাকায় কারা নাকি আক্রমণ করে মারধোর পর্যন্ত করেছে।…. আজ আশ্চর্য হচ্ছি যে, এ সময়ে কারু কাছে কাজীর নাম করলেও শিটকে ওঠেন, পাছে লজ্জা পেতে হয়, কি ক্ষোভ!.. আপনাকেই শুধু এ বিষয়ে অনুরোধ করতে পারি আপনি ওকে দেখবেন। ওর মা হয়ে বোন হয়ে অনুরোধ করছি।…… যদি কোনো রকমে তাকে ধরে বেঁধে কলকাতা আনতে পারেন তবেই রক্ষা। নয় তো ওর লজ্জা, আমাদের লজ্জা, মোসলেম সমাজের লজ্জা, মুসলমান সাহিত্য সেবীদের লজ্জা, যদি ও এখন না হারিয়ে বসে।….. রবীন্দ্রনাথের পর আর এক রবীন্দ্রনাথ হয়তো হবে। কিন্তু কাজী নজরুল ইসলাম আর হবে না।”
১৮। বাঙলা, বাঙালি, আধুনিকতা ও নজরুল : ড.আহমেদ রফিক : পৃ ৯৪-৫
১৯। নজরুল রচনাবলী ৪র্থ খণ্ড পৃষ্ঠা ৩৮৩ “… আমি এত দুর্বল হয়ে পড়েছি এবার বুঝি সামলানো দায় হবে…..শুয়ে শুয়ে কয়েকটা গজল লিখেছি উর্দু গজলের সুরে…. দুটো তোমার কাছে পাঠাচ্ছি- বঙ্গবাণীতে দিয়ে আমায় তাড়াতাড়ি কিছু নিয়ে দেবার জন্য। অন্য সব জায়গায় দশ টাকা করে দেয় আমায় প্রত্যেকটা কবিতার জন্য, একথা ওদের বোলো। গান দুটি পেয়েই যদি ওরা টাকাটা দেয় তা হলে আমার খুব উপকারে লাগে। আমাদের আর মান ইজ্জত রইল না, মুরলীদা-না, অর্থাভাব বুঝি মনুষ্যত্বটাকেও কেড়ে নেয় শেষে।…. বঙ্গ বাণীর সঙ্গে বন্দোবস্ত করে দাও না মুরলীদা- ওঁরা প্রতি মাসে কিছু করে দেবেন, আমিও সে অনুসারে লেখা দেবো প্রতি মাসে।”
২০। নজরুল কথা : শান্তিপদ সিংহ।
২১। ভাগ হয়ে গেল নজরুল : ড. কালী চরণ দাস ও প্রবীর আচার্য : বিস্তৃতিঃ তারশঙ্কর স্মরণ-সংখ্যা, ২০০৬
