Published on – Sunday, November 23, 2025

অমাবস্যা

নরেশ মণ্ডল

  একটা অনুভূতি বয়ে বেড়াচ্ছিল সুনন্দ। যত সময় যাচ্ছে ততই এক আবহসংগীত বেজে উঠছে মনের গভীর গোপন কোন স্থান থেকে। অন্যসময় অনেক অন্য অনুভূতিই বয়ে গেছে। এটার সঙ্গে কেমন যেন অন্যগুলোর মিল খুঁজে পায় না। সামান্যতম একটু মিলও নয়। কেন এমন হয় ! খবরটা এলই। স্বাভাবিক ছন্দের তার ধীর লয়ে কাটতে শুরু করে। বেতালা সুর। নানা ছন্দে নানা সুরের তার বেজে চলে মানব জীবনের পরতে পরতে। আমরা কতটা ধরতে পারি আর কতটাই বা তার সুরে নিজেকে মেলতে পারি। তবুও নিজস্ব চরিত্রের এক এক রকমের ভূমিকা পালন করে যাই। যেতে হয়। আর এটাই স্বাভাবিক।

   তিন্নি ঠিকই করেছিল সে যাবে। সে যখন ঠিক করেছে তখন সে যাবেই। আর এখানে আটকানোর মতো তেমন কোন বিষয়ও সামনে নেই সুনন্দর। ওর মাও সেটা জানে। খবরটা পাবার পরই তার চেতনায় কে যেন নাড়া দিয়ে গেল। কাউকে কোন সুযোগ না দিয়েই সে বেরিয়ে পড়েছিল। সেই নিয়ে এসেছিল। বেলা ক্রমে গাছের মাথা থেকে সরতে শুরু করেছে। আছড়ে পড়ল স্রোত। এ স্রোতের শব্দ সুর তো অন্য রকম। মেলে না। ক্রমে জলকণা কেমন যেন ঝাপসা করে। মনকে শক্ত করা ছাড়া এখন কিছু  করার নেই। সামাল দিতে হবে সুনন্দ ভাবে কথাগুলো। তার গালে গাল ঠেকিয়ে ছবিটা মোবাইলে দেখে তিন্নি। প্রকাশ্যে ভেঙে পড়েনি। আবার স্রোত ঠেলে বেরিয়ে পড়া। এবার নানা শব্দ-সুরের উত্থান। সুনন্দ জানে আমাদের যাপনচিত্রে এমন করেই ঘটে চলেছে নানা ঘটনাবলী। হাসপাতাল ঘর। ধকল গেছে বেশ কতগুলো দিন। টানাপড়েন চলেছে মননে। বটগাছের ছায়ার মতো অনেকটা বিস্তার ছিল। ছায়ায় এলে সে এক অন্য প্রশান্তি। নাতি নাতনিদের আব্দার। খুনসুটি। কতটা টান সেটা না দেখলে বোঝা যায় না। তাই তো ফিরে ফিরে আসা। এবার হলো তারই অবসান। আর বেশি সময় আটকানো যায় না। ছেড়ে দিতে হলো। ‘ছাড়িব না তোমা, ছাড়িব না’ হৃদয় যায় ভেঙে।

  গলি থেকে বড় রাস্তা ধরে এগিয়ে চলা। এ পথ চেনা। এ পথে আমাদেরও একদিন যেতে হবে সুনন্দ ভাবে। অনেক বার এ পথে আসা হয়েছে তার। বেশ কয়েটা মন্দির আছে। রাস্তার ধারে ছোট বড় দোকান। এ দোকানগুলো হাসপাতালের কাছে থাকা ‘দিবা রাত্রি খোলা’ ওষুধের দোকানের মতো। বেশিরাতে চেনে তালা লাগিয়ে রাখে। তোমার কোন অসুবিধা নেই প্রেসক্রিপশান বাড়াও ওষুধ থাকলে পেয়ে যাবে। আর এই দোকানগুলোয় প্রায় সময় ভিড় লেগে থাকে। দিন রাত।

  গঙ্গার ধারে এসে দাঁড়ায় তিন্নি। বুক সমান রেলিং। সময় যত এগচ্ছে এক বিষণ্ণতা তাকে গ্রাস করছে। অন্য সময় হলে গঙ্গার দৃশ্য, লঞ্চ, নৌকা তার মোবাইলের লেন্সবন্দি হতো। কত ছবি না তার তোলা আছে। দিদুনেরও। মোবাইলটা অনেক আগেই সুনন্দর হাতে দিয়ে দিয়েছে। সুনন্দ খেয়াল রাখছে মেয়ের দিকে। মাঝে মাঝে ধ্বনি ওঠে। নতুন কেউ এল। এক কফিনবন্দি সেনার দেহ এল। সবার মধ্যে আগ্রহ। সুনন্দ, তিন্নি আরও অনেকে দেখল। তার পাশেই নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে আছে একজন। দিদুন। তিন্নির আদরের দিদুন। কতবার যে এই বুড়ি এই বুড়ি বলে ডাকত। গালটা টিপে দিত। জড়িয়ে ধরত। বাথরুমে ছাড়া তিন্নির একটা মামুলি আংটি পেয়ে সেটা আঙুলে সেই যে গলিয়েছে তা আর খোলেনি। বয়সকালের এ এক অন্য খেয়াল যার হিসাব না করাই ভালো। ঘুমানোর সময় বালিশ এগিয়ে দেওয়া কলেজে পড়া তিন্নির একটা কাজ ছিল। মাঝে মাঝে ঘুমের মধ্যে পা নাড়তেন। বেশ মজা লাগত তিন্নির। চোখে চশমা পরা থাকলে খুলে পাশে রেখে দিত সে। নাতনি মিষ্টি খাবার কথা বললে দিব্যি ঘাড় কাত করে সায় দিত। জানেন মিষ্টি খাওয়া নিষেধ । সুগার প্রেসারে জর্জরিত। বড়রা কেউ জানলে বকুনি নিশ্চিত। তিন্নিও নিশ্চিত জানে। বুড়ো মানুষ খেতে তো ইচ্ছে হয় সে নাতনি হয়ে তাই  বাধসাধে না। হাতে লাগিয়ে দিয়েছিল নেলপালিশ। তাও বেশ কিছুদিন হলো। হাসপাতালে যাবার আগে। এখনও তা আঙুলে উজ্জ্বল। আজ হাসপাতাল থেকে বাড়ি ঘুরে চলে আসতে হলো গঙ্গার ধারে শেষ পারানির কড়ি নিয়ে। যাত্রা হলো শেষ দাও বিদায়। বুকের ভেতর কষ্টটা দলা পাকিয়ে উঠে আসে সারা শরীরে। চশমাটা খুলে হাতে রাখে সুনন্দ। তিন্নি আবার এগিয়ে দিদুনের মাথার কাছে বসে পড়ে। মাথায় গালে হাত বোলায়। যেমন বোলাতো, গালের নরম চামড়া টিপে দিত। দিদুন হাসত। মাথার ধার দিয়ে একটা লাল রেখা। একটু হাত দিতেই দেখে রক্ত। পাশ থেকে একজন বলল গলার কাছে চ্যানেল করেছি তার জন্য একটু রক্ত। শুকিয়ে গেছে দেখ। না, এখনও তরল রক্ত গড়িয়ে যাচ্ছে। এবার বাখারি উপর শোয়ানো হবে। তারপর !

    গলগল করে রক্তে ভেসে গেল মৃতদেহের ট্রেচার। গড়িয়ে গেল মেঝেতে। লাল, বড্ড বেশি লাল মনে হলো তিন্নির। এমন হয় নাকি! চ্যানেল কিভাবে বন্ধ করতে হয় জানে না ? এইভাবে রক্ত বেরিয়ে আসবে। চিৎকার করে ওঠে তিন্নি। দিদুনের রক্ত। সত্তর হাজারের বিল ধরিয়েছিল যাদবপুরের একটি বেসরকারি হাসপাতাল। সরকারি এক হাসপাতাল রেফার করেছিল তাদের অধীন এই রোগীকে। তিন্নির মনে জন্ম নেয় হাসপাতাল সম্পর্কে এক বিরূপ ধারণা। ওর কাছাকাছি বয়সী সকলের মনেই এক ক্ষোভ জন্ম নিল ভবিষ্যতের জন্য।

   সামান্য মানবিকতাও থাকবে না। সম্পর্ক শুধু টাকার। মানুষের সেবাও টাকা দিয়ে পাওয়া যায় না। সেবা বলে আর কিছু রইল না বাবা। সুনন্দ মেয়ের মাথায় হাত দেয়। আয় উঠে আয়। এবার আগুন হয়ে উঠবে দিদুন। তিন্নির এই প্রথম দেখা। শেষ দেখা। ভিজে যায় চোখের পাতা। চল আর দেখতে হবে না। কান্না কান্না কান্না। আর এর ভিতরে জন্ম নিল ক্ষোভ। যেটার আগুন ধিকি ধিকি জ্বলতে থাকবে।

  নদীর জলের শব্দ। গঙ্গা বয়ে যাচ্ছে অনেকটা নিচ দিয়ে। সূর্যের তাপ কখন কমে গেছে। দিগন্তে লাল আভা ছড়িয়ে বিদায়। দু পারে জ্বলে উঠছে আলো। এখনও কিছুক্ষণ অপেক্ষা। তিন্নি বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে বলে, বাবা আজ কি অমাবস‌্যা। সুনন্দ আকাশের দিকে তাকায়। ধীর গলায় বলে অমাবস্যাই হবে।

Scroll to Top