Sunday, November 23, 2025
কাকামনি
সিদ্ধার্থ সিংহ
ছোটবেলা থেকে কাকামণির কাছে ওই গল্পটা যে কত বার শুনেছি, তবু এখনও আমরা ভাইবোনেরা এক জায়গায় হলে, আর সেখানে যদি কাকামণি থাকেন; তা হলে আর কোনও কথা নেই, ফের উঠবে সেই অদ্ভুত গল্প এবং আমরা এই বয়সেও মুগ্ধ হয়ে শুনব তাঁর কলেজ জীবনের প্রথম চাকরি করতে যাওয়ার সেই গা ছমছম করা গল্প।
কাকামণি তখন কলেজে পড়েন। হঠাৎ একদিন দাদুকে এসে বললেন, কাগজে একটা বিজ্ঞাপন দেখে আবেদন করেছিলাম। এবং হবে কি হবে না, তাই কাউকে কিছু না জানিয়ে ইন্টারভিউও দিয়ে দিয়েছিলাম। আর অবাক কাণ্ড, অতগুলো ছেলের মধ্যে থেকে একমাত্র আমিই নির্বাচিত হলাম এই চাকরির জন্য। লোভনীয় চাকরি। দারুণ জায়গা। সব রকমের সুযোগ-সুবিধা আছে। অসুবিধে যা, তা হল একটু দূরে। দূরে বলতে সাত সমুদ্র তেরো নদীর পারে নয় ঠিকই, তবু দূরেই। দেশের গণ্ডির বাইরে হলে তাকে তো দূরই বলতে হবে, না কি?
Sunday, November 23, 2025
আকাশের সাতটি তারা
সিদ্ধার্থ সিংহ
একটা মালি ছিল। সে কাজ করত ব্রহ্মদেশের রাজার বাগানে। বাগানটা ভারী সুন্দর। নানান গাছগাছালিতে ভরা। ফুলে-ফুলে ছাওয়া। বাগানটা রাজার এত প্রিয় ছিল যে রানিকে নিয়ে মাঝে মাঝেই তিনি বিকেলের দিকে ঘুরতে আসতেন। তাই বাগানটাকে সব সময় পরিপাটি করে সাজিয়ে রাখার জন্য প্রায় সারাক্ষণই বাগানের পিছনে পড়ে থাকত সে। কখনও গাছের গোড়ার মাটি আলগা করে দিত। কখনও সার দিত। কখনও গাছগুলোকে স্নান করিয়ে দিত তো কখনও অবাঞ্ছিত ডালপালা ছেঁটে দৃষ্টিনন্দন করে তুলত গাছগুলোকে। কখনও আবার নতুন নতুন চারা পুতত।
গাছপালা নিয়ে দিন-রাত এতই ব্যস্ত থাত যে বাড়ি যাবারই ফুরসত পেত না সে। বাগানের এক কোণেই পড়ে থাকত। নিজের বলতে থাকার মধ্যে ছিল তার একটা বউ। আর একটা মুরগি। আর সেই মুরগির ছ’-ছ’টি ছানা। তার কোনও ছেলেপুলে ছিল না। তাই মুরগিগুলোকে সে খুব ভালবাসত। মনে করত, ওই মুরগিটাই তার মেয়ে আর ছানাগুলো তার নাতি-নাতনি।
বিষয়-সম্পত্তি না থাকলেও তার মনে কোনও খেদ ছিল না। বেশ সুন্দর ভাবেই দিন কেটে যাচ্ছিল তার। হঠাৎ একদিন এক বৌদ্ধ পুরোহিত এসে হাজির হলেন তার বাগানের সামনে। দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে তিনি বললেন, আমি অনেক দূর থেকে হাঁটতে হাঁটতে আসছি। আমি ক্লান্ত। ক্ষুধার্ত। তৃষ্ণার্ত। মাথা গুঁজবার জন্য একটুখানি ঠাঁই চাই।
Sunday, November 23, 2025
শেষবেলায়
তপন বন্দ্যোপাধ্যায়
সবুজ ঝাউয়ের সারির পিছনে মস্ত লাল বিল্ডিং, তার সামনে দিয়ে হুইলচেয়ারে বসে দীপ্তার্ক খুব ধীরে ধীরে লনের দিকে আসছে এমন একটি দৃশ্য চোখে পড়তে বুকের ভিতর চলকে উঠল স্নেহার৷
গত তিনদিন সে লনে আসতে পারেনি তার নিজের শরীরের প্রবল অবনতি ঘটায়৷ তিনদিন আগে কেমো নিতে গিয়েই হঠাৎ কেঁপে–কেঁপে উঠছিল তার সমস্ত শরীর, কিছুক্ষণের জন্য মনে হয়েছিল নিশ্বাস বন্ধ হয়ে গিয়েছে তার৷ ডাক্তার ফরমান জারি করেছেন একদম বেডরেস্ট৷ তার আগে দীপ্তার্র্কও দুদিন আসতেপারেনি তার শরীর খারাপ ছিল বলে৷ তাই আজকের এই সাক্ষাৎ স্নেহার কাছে খুবই কাঙক্ষণীয়৷
বিকেলের এই সুন্দর মুহূর্তটির জন্য সে গত দু–মাস ধরে প্রতিদিন অপেক্ষা করে একবুক ব্যাকুলতা নিয়ে৷ কিন্তু রোজ তো দেখা হয় না কোনও দিন তার শরীর খারাপ থাকে, কোনও দিন দীপ্তার্কর৷ বেশ কয়েকদিন পরে দেখা হচ্ছে বলে আজ খুবই তীব্র আকুতি বোধ করছে সে৷ কিন্তু অপেক্ষার এই মুহূর্তগুলো যেন অন্তহীন৷ দীপ্তার্ক খুব ধীরে ধীরে, এক–পা এক–পা করে আসতে পারে৷ কিন্তু পা তো নয়, সে তো বসে আছে হুইলচেয়ারে, সেই হুইলচেয়ারের চাকা এগোয় যেন পায়ে–পায়ে৷ কেন না পরমার্থর পায়ে কোনও জোর নেই, ক্রমশ কমে আসছে তার হাতের জোরও৷ শুধু হাত বা পা–ই নয়, তার সমস্ত শরীরেই ক্ষয় চলছে দ্রুত৷ ক্ষয় কিংবা পচন৷
কতই বা বয়স দীপ্তার্র্কর? চব্বিশ বা পঁচিশ৷ এই বয়সে তার বাইক নিয়ে দাপিয়ে বেড়ানোর কথা৷ পরিবর্তে তার বাহন হুইলচেয়ার৷
হাসপাতালের ওয়ার্ড থেকে একজন হেল্পার সঙ্গে আসার কথা, কিন্তু তাদের আসার কোনও ঠিকঠাকানা নেই৷ অনেক সময় দীপ্তার্র্ক অপেক্ষা করে দেখেছে তাদের কেউ এলই না৷ বাধ্য হয়ে দুর্বল শরীরে সে নিজেই চালাতে সুরু করে হুইলচেয়ারের চাকা৷ সামান্য এই পিচপথটুকু পেরোতেই তার সময় লাগে বহুক্ষণ৷ হাঁপিয়েও যায় প্রচণ্ড৷ তাতেও তার উৎসাহের অন্ত থাকে না, কেন না সে জানে তার জন্য অপেক্ষা করে আছে স্নেহা৷
Sunday, November 23, 2025
অমাবস্যা
নরেশ মণ্ডল
একটা অনুভূতি বয়ে বেড়াচ্ছিল সুনন্দ। যত সময় যাচ্ছে ততই এক আবহসংগীত বেজে উঠছে মনের গভীর গোপন কোন স্থান থেকে। অন্যসময় অনেক অন্য অনুভূতিই বয়ে গেছে। এটার সঙ্গে কেমন যেন অন্যগুলোর মিল খুঁজে পায় না। সামান্যতম একটু মিলও নয়। কেন এমন হয় ! খবরটা এলই। স্বাভাবিক ছন্দের তার ধীর লয়ে কাটতে শুরু করে। বেতালা সুর। নানা ছন্দে নানা সুরের তার বেজে চলে মানব জীবনের পরতে পরতে। আমরা কতটা ধরতে পারি আর কতটাই বা তার সুরে নিজেকে মেলতে পারি। তবুও নিজস্ব চরিত্রের এক এক রকমের ভূমিকা পালন করে যাই। যেতে হয়। আর এটাই স্বাভাবিক।
তিন্নি ঠিকই করেছিল সে যাবে। সে যখন ঠিক করেছে তখন সে যাবেই। আর এখানে আটকানোর মতো তেমন কোন বিষয়ও সামনে নেই সুনন্দর। ওর মাও সেটা জানে। খবরটা পাবার পরই তার চেতনায় কে যেন নাড়া দিয়ে গেল। কাউকে কোন সুযোগ না দিয়েই সে বেরিয়ে পড়েছিল। সেই নিয়ে এসেছিল। বেলা ক্রমে গাছের মাথা থেকে সরতে শুরু করেছে। আছড়ে পড়ল স্রোত। এ স্রোতের শব্দ সুর তো অন্য রকম। মেলে না। ক্রমে জলকণা কেমন যেন ঝাপসা করে। মনকে শক্ত করা ছাড়া এখন কিছু করার নেই। সামাল দিতে হবে সুনন্দ ভাবে কথাগুলো। তার গালে গাল ঠেকিয়ে ছবিটা মোবাইলে দেখে তিন্নি। প্রকাশ্যে ভেঙে পড়েনি। আবার স্রোত ঠেলে বেরিয়ে পড়া। এবার নানা শব্দ-সুরের উত্থান। সুনন্দ জানে আমাদের যাপনচিত্রে এমন করেই ঘটে চলেছে নানা ঘটনাবলী। হাসপাতাল ঘর। ধকল গেছে বেশ কতগুলো দিন। টানাপড়েন চলেছে মননে। বটগাছের ছায়ার মতো অনেকটা বিস্তার ছিল। ছায়ায় এলে সে এক অন্য প্রশান্তি। নাতি নাতনিদের আব্দার। খুনসুটি। কতটা টান সেটা না দেখলে বোঝা যায় না। তাই তো ফিরে ফিরে আসা। এবার হলো তারই অবসান। আর বেশি সময় আটকানো যায় না। ছেড়ে দিতে হলো। ‘ছাড়িব না তোমা, ছাড়িব না’ হৃদয় যায় ভেঙে।
Sunday, November 23, 2025
হ য ব র ল
মৃত্যুঞ্জয় দেবনাথ
আসুন, পরিচয় করিয়ে দিই। ইনি সৌম্যজিৎ, অর্থাৎ মিস্টার পাপান।
আমার শ্রীমান। লেজুড়বিহীন আস্ত হনুমান একটি। মুখে ‘উফ্-উফ্’ শব্দটিই ছাড়েন না কেবল, বাকি সব সিমটমই ওই উৎকট প্রাণীটির মতন। যেমন, জীবনে হাঁটতে শেখেননি ইনি। ছোটেন। এবং তিরবেগে। কালেভদ্রে স্থির হয়ে বসেন। দিন-রাতের অধিকাংশ সময়ই সারা সিঁড়ি-বারান্দা আর ঘরজুড়ে লাফান, ঝাঁপান। নৃত্য করেন। কখনো দক্ষিণী স্টার প্রভু দেবা, কখনো জিৎ, বা দেব-রূপে। অত্যাশ্চর্য এই, সকলের মুখে তবুও ‘ভালোছেলে’ বলেই পরিচিত এই পাপানচন্দ্র। উদাহরণ, রাত্রি-দিন চব্বিশঘন্টা লায় দিয়ে মাথায় তোলা ঠাকুমার কাছে সোনারচাঁদ। প্রানবল্লভ। ঠাকদার নয়নের মণি।
আর ওই যে, বেলা ন’টা তিরিশেও খাটে শায়িত, ইনিই আমার সহধর্মিনী। আলপনাদেবী।
আলস্যের বটবৃক্ষ একখানি। তেমনি সৌখিন, মোমের পুতুল। ফুলের ঘায়ে মূর্ছা যান। কিন্তু ঠোঁট উল্টে বলতে যাবেন কিছু এইসব অভিযোগ জানিয়ে-টানিয়ে, তবেই হয়েছে, বাক্যবাণে ভূপতিত হবেন তক্ষুনি। অর্থাৎ এমনই বিষমিশ্রিত সে বাক্যবাণ। এমনই দাহসৃষ্টিকারী, জ্বালাময়ী। একবার সম্মুখ সমরে পড়েছেন তো সহজেই অনুমান করতে পারবেন, এর চাইতে জ্বলন্তঅগ্নিকুণ্ড কত শীতল।
